পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

হো সংস্কৃতি

হো ভাষার অভিধান অনুসারে ‘হো’ শব্দের অর্থ হলো মানুষ। এদের প্রাচীন ধর্ম হলো সারনা এবং ৯০ শতাংশের বেশি হো জনজাতির মানুষ এই ধর্ম অনুসরণ করেন। বেশিরভাগ হো জনজাতির মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত হলেও এদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব কোনো জমি নেই, অন্যের জমিতে মজুর হিসেবে কাজ করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়া হো সমাজের মানুষের বসবাসের স্থানে লৌহ আকরিকের প্রাচুর্য থাকায় হো জনজাতির বেশ কিছু মানুষ খনি শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেন। এদের প্রধান উৎসব হলো ‘মাঘ পরব’, যা প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষে ফসল কাটা ও ঘরে তুলে নেওয়ার পর অনুষ্ঠিত হয়। এটি হো জনজাতির মান্য সৃষ্টির দেবতা অর্থাৎ ‘সিং-বোঙ্গা’র উপাসনা যা এক সপ্তাহ ধরে চলে। হো সমাজ শাল গাছকে পবিত্র বলে মনে করে এবং শাল গাছে ফুল ফুটলে বসন্ত কালের মাঝামাঝি সময়ে এরা ‘বা পরব’ অর্থাৎ ফুলের উৎসব পালন করে। কৃষির সঙ্গে জড়িত উৎসবগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘সোহরাই’ অথবা ‘গাউমারা’। এসময় গান ও নাচের মাধ্যমে কৃষিকাজে ব্যবহৃত গবাদি পশুকে সম্মাননা জানানো হয়। প্রথম বীজ বপনের দিনে ‘বাবা হেরমুতু’ নামক উৎসব পালন করা হয়। হো জনজাতির পুরোহিত ‘পাহান’ নামে পরিচিত, যার সঙ্গে কথা বলে এই তিনদিন ব্যাপী উৎসবের দিন স্থির করা হয়। বসন্ত কালের শেষে ‘জোমনামা পরব’ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নির্বিঘ্নে ফসলের চাষ ও কাটা সম্পন্ন হওয়ার জন্য দেবতাদের ধন্যবাদ দেওয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য উৎসবগুলির মধ্যে বাহা পরব, রাজাশালা, হেরো পরব, বাহতাউলি পরব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নৃত্য হো সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাঘ পরবের সময় ‘আখাড়া’ নামে নাচের জন্য নির্দিষ্ট একটি মাঠে গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে নৃত্য প্রদর্শন করে। এদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে দাম অর্থাৎ ড্রাম, ঢোলক, ডুমেং অর্থাৎ মন্দার এবং রুতু অর্থাৎ বাঁশি উল্লেখযোগ্য। দিয়েং নামে একপ্রকার বিশেষ মদ এরা উৎসবের সময় পান করে।

হো সমাজে মহিলাদের উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। স্ত্রীদের পুরুষের সঙ্গী হিসেবে দেখা হয়। এদের সমাজে বিবাহের সময় কন্যাপণ দেওয়ার রীতি প্রচলিত। হো সমাজে পুরুষের তুলনায় মহিলার সংখ্যা বেশি। শিশুর জন্মের সময় প্রসূতিকে কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হয়। গর্ভাবস্থা প্রকাশিত হওয়ার পর চুরিং-বোঙ্গা নামে এক দুষ্ট আত্মার উদ্দেশ্যে একটি মোরগ বলি দিয়ে নবাগত ভ্রুণকে রক্ষা করার প্রার্থনা করা হয়। সবসময় প্রসূতির কাছে পরিবারের বয়স্থ কোনো মহিলাকে রাখা হয়। সন্ধের পর বাড়ির বাইরে এলে তার কোনো দেবস্থান বা দাহ করার জায়গায় দাঁড়ানো বা বসা নিষিদ্ধ থাকে। তার জন্য রান্না করে খাদ্যদ্রব্য পূর্বপুরুষকে নিবেদন করাও নিষিদ্ধ। কোনো শিকার বা মাছ ধরার অস্ত্র ধরাও তার জন্য নিষিদ্ধ থাকে। মাছ বা অন্য কোনো প্রাণীর মাথাও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা নিষেধ থাকে। রান্নার সময় আম গাছের কাঠ ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ থাকে। হো সমাজের বাড়িতে প্রসবের জন্য আলাদা ঘর থাকে। শিশুর জন্মের আটদিন পর প্রসূতির অশৌচ শেষ হয়। তখন শিশুর পিতা মা ও শিশুর জন্য রান্না করে তা প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করে। আগে হো সমাজে ধাইমা এর প্রচলন থাকলেও বর্তমানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকাই প্রসব করানোর কাজটি সম্পন্ন করেন।

হো জনজাতির ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক রীতিনীতিগুলি বর্তমানে অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে হো জনজাতির কোনো ঘনসন্নিবিষ্ট বসতি না থাকার ফলেও ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবনমন ঘটছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Anderson (Gregory S. ed.); 2008 The Munda Languages.

Census of India-2011

Ho: A Language of India; Ethnologue. SIL International

Mohanta, Dr. Basanta Kumar; Birth Rituals of the Ho Tribe; The Tribal Tribune