পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

রংমেই সংস্কৃতি

এরা মূলত কৃষিকাজের উপর নির্ভর করে গ্রামকেন্দ্রিক জীবনযাপন করে। প্রধানত ঝুমচাষই এদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায়। এছাড়া বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং কাঠ, বাঁশের কাজ এদের জীবিকা অর্জনে সাহায্য করে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ সর্বপ্রথম এদের নিজস্ব অধিকৃত অঞ্চলে ব্রিটিশদের আগমন ঘটে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ এরা হাইপোও যাদোনাং এবং রাণী গাইদিনলিউ এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। ব্রিটিশরাই চা-শ্রমিক হিসেবে এদের মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডের পার্বত্য অঞ্চল থেকে অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের চা-বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলে নিয়ে আসে। এদের ধর্ম হিসেবে প্রাচীনকালে অ্যানিমিস্ট ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও বর্তমানে খ্রিষ্টানধর্ম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এদের অ্যানিমিস্ট ধর্মের প্রধান দেবতা হলেন রাওয়াং। এরা আত্মা, আত্মার মুক্তি, পুণর্জন্ম, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি ধারণায় বিশ্বাসী। এদের জীবন বেশকিছু অলিখিত এবং প্রচলিত আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শিশুর জন্মের পর তার মঙ্গল কামনা করে প্রধান দেবতার উদ্দেশ্যে একটি মোরগ উৎসর্গ করা হয়। এদের নিজস্ব বিশ্বাস অনুসারে কোনো কুকুর বাসযোগ্য বাড়ির উপরে উঠে পড়লে তা ক্ষতিকর।

এই জনজাতির বিবাহ ‘নৌসুয়ানমেই' নামে পরিচিত। এদের মধ্যে মনোগ্যামি অর্থাৎ একগামীতাই প্রচলিত পলিগ্যামি সম্পর্কে কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও এটি রংমেই জনসমাজে তেমন প্রচলিত নয়। এদের সমাজ কতকগুলি গোত্র ও উপগোত্রে বিভক্ত। একই গোত্রভুক্ত পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে বিবাহসম্পর্ক রংমেই সমাজে স্বীকৃত নয়; অর্থাৎ এদের মধ্যে ক্ল্যান-এক্সোগ্যামিই প্রচলিত। বিবাহ সাধারণত গ্রামের প্রধান পুরোহিতের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়। এদের গ্রামীণ শাসনব্যবস্থা একটি গ্রামসংসদ অথবা ‘পেই’ এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

রংমেই জনজাতির বেশ কয়েকটি নিজস্ব উৎসব পালনের প্রথা রয়েছে; যেমন- ‘নানু-নগাই'- শিশুদের কান বেঁধানো, ‘নাপকাওদাই নগাই’ অর্থাৎ ফসল বোনার সময় পালিত উৎসব, ‘গুদুই-নগাই' অর্থাৎ ফসলের বীজ বপন করা সম্পূর্ণ হওয়ার পর পালিত উৎসব, ‘তুন-নগাই’ অর্থাৎ বৃষ্টির উৎসব, ‘পুয়াকফাট-নগাই’ অর্থাৎ নতুন ফসল ওঠার পর পালিত উৎসব, ‘চাকাক-নগাই’ অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মার শান্তি কামনার অনুষ্ঠান, ‘গান-নগাই’ অর্থাৎ শীতকালে পালিত উৎসব ইত্যাদি। এদের সমস্ত উৎসবই চাঁদের বৃদ্ধির সময়কার ১৫ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। কোনো উৎসবই চাঁদের হ্রাস অর্থাৎ পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা- এই সময়কালের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় না। গান-নগাই হলো এদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। এটি প্রতি বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এদের নিজস্ব চান্দ্রমাসের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই উৎসব ‘ওয়াকচিং' মাসের ১৩তম দিনে পালিত হয়।

তবে খ্রিস্টান মিশনারিদের আগমনের পর এবং তাঁদের দ্বারা রোমান লিপির মাধ্যমে রংমেই ভাষায় বাইবেল অনূদিত হয়। এরপর এই জনজাতির এসব প্রাচীন উৎসব-অনুষ্ঠানের জায়গা নিয়েছে খ্রিস্টান ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান। ইংরেজি ভাষার প্রচার এবং প্রসারের ফলে এদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি সংস্কৃতির সমস্ত অবিচ্ছেদ্য অংশগুলিতে পশ্চিমী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মণিপুরি, নাগামিজ, অসমিয়া, বাংলা প্রভৃতি রাজ্য সরকারি ভাষাগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবেও এদের নিজস্ব ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের অবনমন ঘটছে। এই জনজাতির নতুন প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহের অভাবের কারণে এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। নিজস্ব লিপি না থাকার ফলে এদের ইতিহাস, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যটি ব্যাকরণও রচনা করা সম্ভব হয়নি। উপরোক্ত কারণগুলিই রংমেই ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমাবনমনের জন্য দায়ী।

গ্রন্থপঞ্জী:

Beeju, K. 2014. A Way of the Zeliangrong Nagas with Special Reference to Rongmei (Kabui) Tribe; International Journal of Social Science & Humanities

Census of India- 2011

Deb, D. 2019. A Study on Rongmei Syllable Structure; Journal of Literature, Language and Linguistics

Deb, D. 2019. Relative Clause in Rongmei Naga; International Journal of Linguistics