পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

অঙ্গিকা সংস্কৃতি

এই জনজাতি মণিপুর রাজ্যে বসবাস স্থাপনকারী ১৯টি নাগা জনজাতির মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতার পর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম এই জনজাতিকে উপজাতির মর্যাদা দেওয়া হয়। এই জনজাতির ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের অভাব থাকলেও এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, এই ভাষার লেখ্যরূপটিতে ল্যাটিন ভাষার ২৬টি অক্ষর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অনল ভাষা ব্যবহারকারী জনজাতিটির বিশেষ কিছু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এদের নিজস্ব কিছু গান এবং নাচের অস্তিত্ব রয়েছে যা কয়েকটি নির্দিষ্ট উৎসবের সঙ্গে জড়িত। অনল জনজাতির কোনো মানুষ যদি তার জন্মস্থান ছেড়ে অন্য গ্রামে বসতি স্থাপন করতে চায় তাহলে তাকে “থালখাম” নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করতে হয়, যেখানে অপর গ্রামবাসীদের সকলকে নিমন্ত্রণ করে একটি গৃহপালিত পশুর মাংস ও ‘জু’ নামে একটি বিশেষ দেশি মদ খাওয়ানো হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে উক্ত গ্রামবাসী নিজের অস্থাবর সম্পত্তিগুলির উপর অধিকার স্থাপন করে; যাতে সে ভবিষ্যতে পুরনো গ্রামে ফিরে এলে ঐ সম্পত্তিগুলি পুনরায় ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া অপর একটি নতুন গ্রামে বসতি স্থাপন করতে চাইলে উক্ত গ্রামের প্রধানের অনুমতিও নিতে হয়। এই অনুমতি গ্রহণের প্রথাটি ‘খুলুনা থাংপুঅং’ নামে পরিচিত; যার মাধ্যমে গ্রামের প্রধান এবং গ্রাম-সংসদের সদস্যদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এই প্রথার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উক্ত নতুন গ্রামবাসী গ্রামটির ঝুমচাষের জমি, মাছধরার পুকুর, বসবাসের উপযুক্ত জমি ইত্যাদি ব্যবহার করার অধিকার লাভ করে।

এই জনজাতির দ্বারা পালিত একটি প্রধান উৎসব হলো ‘তোতাংকাম’ অথবা ‘আকাম’। এই উৎসব মূলত এই জনজাতির তথাকথিত সম্পন্ন ব্যক্তিরাই পালন করে থাকে। এই উৎসবে এক সপ্তাহ ধরে গ্রামের সকল মানুষকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। ছয়টি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এই উৎসবটি পালন করা হয়। এই ছয়টি পর্যায় হলো যথাক্রমে ‘জুদোং’, ‘বাথওয়াং’, ‘সাপিয়া’, ‘হিনি’, ‘আকাপিদম’ এবং ‘দুইথু’। এই উৎসবের প্রথম পর্যায়টি টানা দুইদিন এবং দুইরাত ধরে পালন করা হয়। গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রণ করে শুকর অথবা মিথুনের মাংস এবং ঐতিহ্যপূর্ণ দেশি মদ খাওয়ানো হয়। গ্রামের ধনী ব্যক্তিরা মৃত্যুর পর ‘আথোপম’ অর্থাৎ স্বর্গলাভের উদ্দেশ্যে উৎসবটি পালন করে থাকে। এই উৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ কিছু গান এবং নাচের প্রথাও রয়েছে। কিন্তু ধনী বিধবা মহিলা অথবা বিবাহবিচ্ছিন্নরা এই উৎসব পালনের অধিকারী নন। এই উৎসবের দ্বিতীয় পর্যায় ‘বুতাং’ নামে পরিচিত, যেখানে কোনো ব্যক্তির স্ত্রীকে সম্মান জানিয়ে একটি মেগালিথ বা পাথর স্থাপন করা হয়। এই উৎসবের তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ ‘সাপিয়া’ তিনদিন এবং তিনরাত ধরে পালন করা হয়। এই উৎসব যিনি পালন করেন, সেই গৃহকর্তা একটি পরিণতবয়স্ক মিথুন অথবা মহিষ, একটি শুকর। একটি কুকুর, একটি মোরগ এবং ৪৫ বোতল দেশি মদ উৎসর্গ করেন। এই উৎসবের বাকি পর্যায়গুলি যথাক্রমে পাঁচদিন এবং পাঁচরাত; দুইদিন এবং দুইরাত; এবং একদিন ও একরাত ধরে পালন করা হয়। এই উৎসবের শেষ পর্যায়টিতে মানুষের প্রতি দায়িত্বপালনের পর বন্যপশু এবং পাখিদের খাওয়ানো হয়। এই পর্যায়ে গ্রামবাসীদের জন্যও একটি বড়ো শুকর এবং চার বোতল দেশি মদের ব্যবস্থা থাকে। এই উৎসবটি অনল সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হওয়ার কারণে যে ব্যক্তি এটি পালন করতে পারেন তাঁকে সমাজে উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী অনল ভাষা ব্যবহারকারী মানুষরা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসের কারণে এই প্রথা পালনের সুযোগ পান না।

বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসের কারণে এই প্রথা পালনের সুযোগ পান না। এই জনজাতির দ্বারা পালিত অপর একটি প্রথা হলো ‘চেলিং’, যেখানে একটি বড়ো কাঠের গুঁড়িকে মাটিতে পোঁতা হয়। অনল জনজাতির লোককথা অনুসারে “থুমখেল” নামে একজন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি প্রথম এই প্রথাটি পালন করেন। এই প্রথা অনুসারে, একটি বড়ো মিথুনকে দড়ির সাহায্যে ‘পাদুংথিং’ নামক গাছের সঙ্গে বেঁধে ‘কাংসাং’ এবং ‘দো’ অর্থাৎ দা এবং কুঠারের সাহায্যে হত্যা করা হয়। এছাড়া অনল সমাজে নতুন বছরের শুরুতে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করার প্রথাও প্রচলিত রয়েছে, যেটি প্রাচীন অনল সমাজে ‘হ্রুংথা’ নামে পরিচিত থাকলেও বর্তমানে ‘কুমহ্রীন’ নামে পরিচিত। প্রতি বছর ২৩ অক্টোবর ফসল তোলার উৎসব ‘চাভান কুমহ্রীন’ পালন করা হয়। অনল ভাষার শব্দভাণ্ডার অনুসারে ‘চাভান’ শব্দের অর্থ শরৎকাল এবং ‘কুমহ্রীন’ শব্দের অর্থ উৎসব। এই উৎসবের সময় সমস্ত উৎপাদিত ফসল চার্চের সামনে জড়ো করা হয়। এই উৎসবই প্রাচীনকালে ‘হেসু’ নামে পরিচিত ছিলো। এটি পূর্বে অনল জনজাতির প্রাচীন ধর্মীয় রীতি অনুসারে পালন করা হলেও নাগা পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টানধর্মের অনুপ্রবেশের পর চার্চই এই উৎসবটি নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ঝুমচাষের সঙ্গে জড়িত ‘হিলথো’ উৎসব এবং জমিতে ফসল পরিণত হওয়ার পর ‘ছারথো উৎসব পালন করা হয়। অনল জনজাতির নিজস্ব নাচগুলি ‘কামদাম’ অথবা ‘রিদম’ নামে পরিচিত। এই নৃত্যের অনুষ্ঠানে পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই একসঙ্গে অংশ নেয়। এছাড়া শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করলে ‘লুদাম’ নামক জয়ের নাচের অনুষ্ঠান করা হয়। অনল জনজাতির মধ্যে আরও অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসবের প্রচলন থাকলেও খ্রিস্টানধর্ম এবং তার সঙ্গে আগত পশ্চিমি সভ্যতা এই জনজাতির ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় অনল ভাষা ‘ভালনারেবল’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে, কারণ এই জনজাতির শিশু অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের এই ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ কম; ফলে ভাষা-সঞ্চারণের বিষয়টি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের অনল ভাষা ব্যবহারকারী মানুষ এই অঞ্চলের অন্যান্য জনজাতির সঙ্গে সহাবস্থানের মাধ্যমে একটি মিশ্র সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India- 2011

Thumdal Anal, BD. 2018; Anal Culture at a Glance; International Journal of Social Science