চাং জনজাতির মৌখিক উপকথা অনুসারে ‘চাং’ শব্দটি ‘চোগনু’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বটগাছ’। অপর একটি উৎস অনুসারে, চাং জনজাতি অধিকতর পূর্বদিক থেকে এসে নাগাল্যাণ্ডে বসতি স্থাপন করে এবং নিজেদের ‘চাং’ নামে অভিহিত করে; স্থানীয় একটি ভাষায় যার অর্থ ‘পূর্বদিক’। এছাড়া এই জনজাতির মানুষ ‘আও’ জনগোষ্ঠীকেও তাদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করে। আও জনজাতি এবং চাং জনজাতির লোককথার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে, যা পূর্বোক্ত ধারণার সপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করে। ব্রিটিশ শাসনকালে চাং জনজাতি ‘মাজুং’ নামে পরিচিত ছিল।
চাং জনজাতির মধ্যে মূলত চারটি এক্সোগ্যামাস ক্ল্যান অর্থাৎ গোত্রের অস্তিত্ব রয়েছে। চাং ভাষায় এই গোত্রগুলি ‘ফাং’ নামে পরিচিত। হ্যামলেট বারেহ (২০১০) চারটি গোত্রের কথা বললেও ব্রজবিহারী কুমার (২০০৫) চাং জনজাতিকে পাঁচটি পৃথক গোত্রে বিভক্ত করেছেন- চোংপো, উং, লোমোউ, কাংসৌ এবং কুদামজি। চোংপো গোত্রটি আবার সাংদি, হাংওয়াং, হাগিয়ুং, উংপোং এবং মাভা- এই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। এদের জীবন মূলত গ্রামকেন্দ্রিক, গ্রামগুলি ‘খেল’ নামে পরিচিত। সেখানে চাং জনজাতির বিভিন্ন গোত্রের মানুষ সহাবস্থান করলেও তাদের এলাকা নির্দিষ্ট ছিল এবং এরা একে অপরের এলাকায় প্রবেশ করতো না। ব্রিটিশ-পূর্ব সময়ে চাং জনজাতি ‘লাকবৌ’ নামক প্রধান ব্যক্তির অধীনে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করতো। এই পদটি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যেত না, শিকারে নৈপুণ্যের উপর ভিত্তি করে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হতো। পরবর্তীকালে ৫-৬ জন বয়স্ক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রাম সংসদ চাং সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতো। নাগাল্যাণ্ডের রাজ্যসরকার গ্রামোন্নয়ন বোর্ড গঠন করলে সেখানে ৬-৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যের মধ্যে অন্তত একজন মহিলার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী, চাং জনজাতি ‘পেট্রিলিনিয়াল’, এখানে পুরুষের সম্পত্তি ও ভূমির অধিকার স্বীকৃত। এদের সমাজে বিবাহ ‘চুমকানবু’ নামে পরিচিত। বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকারও চাংসমাজে স্বীকৃত। স্থানীয় শাসন নাগাল্যাণ্ডের চাং জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে প্রচলিত হলেও পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে চাং জনজাতির সংঘবদ্ধ বসতি বা গ্রাম গড়ে না ওঠার ফলে এরা অন্যান্য জনজাতির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় বাস করে।
ঐতিহ্যগতভাবে এদের অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল। চিরাচরিত প্রথায় কৃষিকাজের পরিবর্তে ভূমির অনুর্বরতা, সেচব্যবস্থা ও যোগাযোগব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এরা ঝুমচাষেই অভ্যস্ত। ধান, মিলেটজাতীয় শস্য এবং শাকসবজি এদের প্রধান উৎপাদিত ফসল। এছাড়া এরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী অন্য জনজাতির মানুষের সঙ্গে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে জিনিসপত্রের আদানপ্রদান করে থাকে।
২০০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় দেখা গেছে যে, চাং জনজাতির মানুষের ৯৯ শতাংশই বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম চাং জনজাতির মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ‘চাঙ- নাগা ব্যাপটিস্ট অ্যাসোশিয়েশন গড়ে ওঠে। তবে পূর্বে এরা অ্যানিমিজম এবং টোটেম উপাসনায় অভ্যস্ত ছিল। এদের মধ্যে কোনো পারিবারিক, গ্রাম বা গোত্রীয় দেবতার উপাসনার প্রথা না থাকলেও প্রকৃতির মধ্যে বিবিধ আত্মার উপস্থিতিতে এরা বিশ্বাস করে। এর মধ্যে ধানের জমিতে অধিষ্ঠিত আত্মা ‘সাম্পুলে মুখাও’ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্য অনুসারে, গ্রামের পুরোহিত ‘ওংবৌ’ (উং গোত্রের অন্তর্ভুক্ত) সমস্ত ধর্মীয় রীতিনীতিগুলির পালন করে থাকেন।
খ্রিস্টান ধর্মের অনুপ্রবেশের পর চাং জনজাতি পশ্চিমী পোশাক ও শিক্ষায় অভ্যস্ত হলেও এদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো শাল। বিভিন্ন বয়স এবং গোত্রের ক্ষেত্রে এই শালের নকশা পৃথক হয়। বর্তমানে খ্রিষ্টান ধর্মের পালিত উৎসবগুলি চাং জনজাতির মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী ৬টি উৎসব রয়েছে- জুলাই-অগস্ট মাসে পালিত ‘নাকলুলেম’ যা ৬ দিন ধরে পালিত হয়, এই সময় কোনো বিবাহ নিষিদ্ধ; ‘পোয়াংলেম’, যা ডিসেম্বর মাসে পালিত হয়; ‘কুদাংলেম’ এপ্রিল মাসে পালিত হয়; এছাড়া অপর তিনটি উৎসব হলো ‘জেনিয়ুলেম’, ‘মুয়োংলেম’ এবং ‘মনয়ুলেম’। তবে এই উৎসবগুলি পালনের প্রথা ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে।
অন্যান্য সরকারি ভাষা ও সর্বোপরি ইংরেজি ভাষার উপস্থিতি ও শিক্ষার সুযোগের কারণে এবং চাংএকটি মৌখিক ভাষা হওয়ার কারণে উপযুক্ত লিখিত তথ্যের অভাব এই ভাষার ব্যবহারিক অবনমনের মূল কারণ। এছাড়া দুটি ভাষার ব্যবহার, কোড-সুইচিং ও কোড-মিক্সিং এর প্রবণতার ফলে মূলত নাগামিজ ও ইংরেজি ভাষার অনেক শব্দ চাংভাষায় অনুপ্রবেশ করে ভাষাটির বাকরীতি, উচ্চারণ এবং শব্দ ও বাক্যগঠন প্রণালীকে প্রভাবিত করছে। চাংভাষার ব্যবহার নির্দিষ্ট একটি বা দুটি ডোমেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে ভাষাটির সম্প্রসারণের সুযোগ কম। চাং ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষণামূলক কাজের সংখ্যা কম হওয়ায় ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলির পুনর্মূল্যায়ণ জরুরি।
Census of India- 2011
Census of India- 2001
Das, N.K. 2010; Nagas- An Introduction; Anthropological Survey of India
Hamlet Bareh, ed. 2001; Encyclopedia of North-East India: Nagaland. Volume 6
Kumara, B.B. 2005; Naga Identity Concept
Namkung, J. (1996). Phonological inventories of Tibeto-Burman languages