কুড়মালি ভাষা

কুড়মালি একটি ইণ্ডো-আরিয়ান ভাষা যা ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে কথিত। গ্রিয়ারসন্ (LSI ,খণ্ড ৫ ভাগ , ১৯০৩) এই ভাষাকে ইস্টার্ন মাগাহি ভাষার একটি রূপভেদ হিসবে বর্ণনা করেছেন। এই ভাষা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, নদীয়া, মালদা এবং মানভূম অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। ভাষাটি বেদিয়া, ধারুয়া, খোর্টা, কুড়মালি থর নামেও পরিচিত। এছারা ছোট নাগপুর এলাকাতেও এই ভাষা শোনা যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে কুড়মালি ভাষার সাথে প্রাচীন বাংলার প্রামাণ্য সাহিত্য চর্যাপদের ভাষার প্রভূত সাদৃশ্য রয়েছে। ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এই ভাষাটিই ‘পাঁচপরগনাইয়া’ নামে পরিচিত। ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলা ভাষা থেকে কুড়মালিভাষায় শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। তবে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডে কুড়মালিভাষায় পঠনপাঠনের কাজ শুরু হওয়ায় ভাষাটির বিলুপ্তির সম্ভাবনা কম। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম মাহাতো সর্বপ্রথম একটি কুড়মালিভাষার অভিধান রচনা করেন। কুড়মালিভাষায় জীববিজ্ঞানগত ও ব্যাকরণগত-এই দুই প্রকার লিঙ্গ দেখা যায়। এই ভাষা মূলত স্ত্রী ও পুরুষ এই দুই প্রকার লিঙ্গের ভেদ স্বীকার করে। কুড়মালিভাষার গ্রামাটিকাল জেন্ডার অর্থাৎ ব্যাকরঙত লিঙ্গ বাক্যের বিশেষ্য ও ক্রিয়ার সঙ্গে এগ্রিমেণ্ট স্থাপন করে। স্ত্রীলিঙ্গের ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গসূলক পাঁচটি পৃথক সাফিক্স অর্থাৎ অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। এই স্ত্রীলিঙ্গ শব্দগুলি পুংলিঙ্গ শব্দ থেকেই ডেরিভেশনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। কুড়মালিভাষায় একবচনের কোনো মার্কার থাকে না; কিন্তু বহুবচনের ক্ষেত্রে একাধিক মার্কারের প্রচলন রয়েছে যাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মার্কারটি হলো ‘গিলা’।

কুড়মালি মূলত কুড়মিদের ভাষা এবং পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে এই ভাষার ব্যবহারের ফলে বাংলা ও হিন্দির প্রভাব লক্ষণীয়। গ্রিয়ারসন্ এই ভাষাকে একটি Bilingual বা দ্বিভাষিক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কুড়মালি ভাষা বিহার ও ঝাড়খণ্ডে অঞ্চলে দেবনাগরী স্ক্রিপ্টে লেখা হয়ে থাকে এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলা বর্ণমালায় লেখা হয়। মজুমদার (২০১৮) লিখেছেন , কিছু বছর পূর্বে “ছিস”(chis) নামক একটি স্ক্রিপ্টে কুড়মালি ভাষা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে জার অক্ষরগুলি সঙ্গে রোম্যান বর্ণমালার মিল দেখা যায়।

কুড়মালি ভাষা সাধারণত পরিবারের মধ্যে ব্যবহৃত একটি ভাষা। এই ভাষা একটি ব্যবসায়িক ভাষা বা Trade Language হিসেবে পঞ্চ পরগনিয়া অর্থাৎ রাহে, বুন্দু, তামার, সিল্লি ও বারান্দা অঞ্চলে বহুল প্রচলিত। এছাড়াও দক্ষিন হাজারীবাগ এলাকায় এটি ব্যবসায়িক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

২০০১ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবর্ষে ৪২৫,৯২০ কুড়মালি ভাষী বসবাস করে, তবে এর মধ্যে প্রত্যেকে শুদ্ধ কুড়মালি ভাষায় কথা বলে না। এই ভাষার সঙ্গে ওড়িয়া, বিহারি, বাংলা এবং হিন্দি মিশে যাওয়ার ফলে কুরমালি ভাষার অনেকগুলি প্রকারভেদ তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে UNESCO রিপোর্ট অনুযায়ী কুরমালি একটি বিলুপ্ত প্রায় ভাষা, তার প্রধান কারণগুলি মজুমদার (২০১৮) ব্যক্ত করেছেন। কুড়মালি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয় না তাই শিশুরা তাদের ছোটবেলা থেকেই অন্যান্য ভাষা শিখতে থাকে। এই মানভুম অঞ্চলে অন্যান্য আদিবাসী ভাষা এবং বাংলা বলার প্রচলন বেশি থাকায় এই ভাসাটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলে দুটি সেতু ভাষা (Lingua Franca) সাদরি ও নাগপুরিয়া (গ্রিয়ারসন, ১৯০৩ খণ্ড ৫, ভাগ ২ তে এই দুই ভাষা এক বলে চিহ্নিত করেছেন) ভাষায় কথাবার্তা হওয়ার ফলে ব্যবসায়িকভাবে এই ভাষার ব্যবহার কমছে।

সরকারি কাজকর্মের জন্যেও কুড়মালি ভাষা ব্যবহার না হওয়ার কারণে নতুন প্রজন্মের কাছে এই ভাষা সেখার গুরুত্ব কমছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অন্যান্য ভাষী শিক্ষক, শিক্ষিকাদের পড়ানোর ফলে শিশুরা ক্লাসে এই ভাষা ব্যবহার করছে না। কুড়মালি ভাষার মুলত মৌখিক ভাষা হওয়ার কারণে এই ভাষার লোকগান, গল্প ইত্যাদি সঠিক পরিমানে লিপিবদ্ধ হচ্ছে না। যার কারণে এই ভাষা মানুষ ভুলে যাচ্ছে, এটি একটি আদিবাসী ভাষা কিনা তাই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা মত বিরোধ আছে।

ভারতীয় ভাষা লোক সর্বেক্ষণঃ পশ্চিমবঙ্গের ভাষা অনুযায়ী (২০১৭)

কুড়মালি ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ (স্বরধ্বনি)

১। অন্ত্যব্যঞ্জনের পরে অতিরিক্ত স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন- সৎ>সতু (সৎমা ᱻ সতুআইমাঁই)

২। অ,আ-এর হ্রস্ব-দীর্ঘ- দুরকম উচ্চারণই বজায় আছে। যেমন- ভাতৃজায়া>বাং. ভাজ ᱻ কুড়. ভাআজ (দীর্ঘ আ)

৩। স্বরধ্বনির অনুনাসিক উচ্চারণ বজায় আছে- ঘনঅঁ, গাঁও, কুরমেঁক ইত্যাদি

৪। বাংলায়ে যেখানে ‘ও’ উচ্চারণ হয় কুড়মালিতে সেখানে ‘অ’ উচ্চারিত হয়। যেমন- গো ᱻ গঅ, মোর ᱻ মর ᱻ মঁরঅ প্রভৃতি

৫। অ>এ- ময়ূর> মেজুর, আই > এই, ঝাইলদা > ঝেইলদা।

৬। স্বরভক্তি বা মধ্যস্বরাগম- সুবর্ণরেখা>সবরনাখা

কুড়মালি ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ (ব্যঞ্জনধ্বনি)

১। ঞ- এর উচ্চারণ বজায় আছেঃ মাইঞে, খেতেঁঞে, গঁসাঁঞে

২। শিস্ ধ্বনির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র – ‘স’ – এর উচ্চারণ শ্বশুর>সসুর

৩। য়- শ্রুতি অনুপস্থিতঃ হেরিয়া ᱻ হেরিআ, কোয়েল ᱻ কএ্যাল

৪। হ- শ্রুতিঃ বধূটি >বহুড়ী, আমরা ᱻ হামরা

৫। নাসিকীভবনঃ কেঅনঝোর> কেঁউঝর

৬। অল্পপ্রানীভবনঃ শঙ্খনদী > সাঁক্ লদী

কুড়মালি ভাষার বাক্যগঠণ বাংলা ও হিন্দির মতন অর্থাৎ কর্তা- কর্ম- ক্রিয়া (S-O-V)। যেমনঃ

সিয়ারটাঁঞ অঁকে কহলেক

শিয়ালটা তাকে বলল

এই ভাষা ব্যকরণ গত নিয়মগুলি বাংলা ও হিন্দির মতন। কুড়মালি ভাষায় পদ প্রকরণ পাঁচ প্রকার বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় এবং ক্রিয়া। কুড়মালি ভাষাতে বাংলার মত ক্লাসিফাইয়ারস্ দেখা যায় যা গ্রিয়ারসন ইংরেজিতে ব্যবহৃত Determiners এর সঙ্গে তুলনে করেছেন। কুড়মালি ভাষার কারক বিভক্তি অনেকটা বিহারি ভাষার মতন। এছারা বিশেষ্যর অন্যান্য রূপভেদ অর্থাৎ বচন এবং লিঙ্গভেদ দেখা যায় এবং ক্রিয়ার রূপভেদ কাল, ভাব, প্রকার পুরুষ ইত্যাদি দেখা যায়।

গ্রন্থপঞ্জী :

Dash, B. (2014). Kurmali Noun Inflection: Aspectual Inquiry into Gender and Number. International Journal of Linguistics and Literature, VOL-3, Issue-5, 1-14.

Grierson, G. A. (1903). Linguistic Survey in India Vol.5, Part 2.

Mahato, A., & Mahato, P. (2017). Kurmali. In People's Linguistic Survey of India, Volume 31 Part 3 (pp. 197-211). Orient Black Swan.

Majumdar, A. (2018). Kurmali Kinship Trems and Morphology: An Anthropo-linguistic Study. Jadavpur Journal of Languages and Linguistics, VOL-2, N-1, 38-48.

Majumdar, A. (2018). Role of Socio-Economic Variables in Language Shift: A Case Study from West Bengal. Jadavpur Journal of Languages and Linguistics, 40-48.