পুরুলিয়া জেলা
পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমতম প্রান্তে অবস্থিত। পুরুলিয়া সদর, ঝালদা, রঘুনাথপুর ও মানবাজার- এই চারটি ব্লকের সমন্বয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠিত। এই জেলার পূর্বে বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা, উত্তরে বর্ধমান জেলা এবং ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলা, পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের বোকারো ও রাঁচি জেলা এবং পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের সিংভূম ও পূর্ব সিংভূম জেলা অবস্থিত। চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর কারণে এখানে সারাবছর কৃষিকাজ সম্ভব হয় না; কংসাবতী, শিলাবতী, কুমারী, দ্বারকেশ্বর, সুবর্ণরেখা ইত্যাদি নদী প্রধানত বৃষ্টির জলে পুষ্ট হলেও সারাবছর জল থাকে না। প্রধানত খনিজ সম্পদের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা ভারি শিল্প এবং লাক্ষাশিল্পের মতো কুটিরশিল্প পুরুলিয়া জেলার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। পুরুলিয়া জেলার মোট আয়তন ৬২৫৯ বর্গকিমি এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে মোট জনসংখ্যা ২৯৩০১১৫ জন।
পুরুলিয়া জেলার প্রধান সরকারি ভাষা বাংলা হলেও এই জেলার তিনদিকে প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অবস্থানের ফলে (পুরুলিয়া ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের রাজ্য পুণর্গঠন আইন অনুসারে মানভুম জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে) হিন্দি ভাষারও প্রচলন আছে। পুরুলিয়া জেলায় জনজাতির মানুষের সংখ্যা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (প্রথম জলপাইগুড়ি)- ১৮ শতাংশ। এই সমস্ত জনজাতির মানুষ প্রধানত প্রোটো-অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর, প্রধানত সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজ, বিরহর খাড়িয়া ও গোঁদ সম্প্রদায়ের। এদের মধ্যে ষাট শতাংশ সাঁওতাল, এদের ভাষা সাঁওতালি অষ্টম তফশিল অনুসারে ভারতের একটি অন্যতম প্রধান আঞ্চলিক ভাষা। এই ভাষায় ২১ টি ব্যঞ্জন এবং ১৪টি স্বরধ্বনি বর্তমান। সাঁওতালি ভাষায় বাংলার প্রভাব সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিক ক্ষুদিরাম বসুর লেখা ‘সাঁওতালি-বাংলা সমশব্দ অভিধান’ এবং ‘বাংলা সাঁওতালি ভাষা সম্পর্ক’ বইদুটিতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব লিপি অলচিকির উদ্ভব ও বিকাশ সাঁওতালি মাধ্যমে লেখাপড়া করার সুযোগ বৃদ্ধি করেছে।
খাড়িয়া জনজাতির ভাষা খাড়িয়া অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর দক্ষিণ মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত; এর নিকট সম্পর্কযুক্ত ভাষা হলো জুয়াং। এই ভাষার নিজস্ব লিপি নেই, দেবনাগরী, ল্যাটিন ইত্যাদি লিপি লেখার কাজে ব্যবহার করা হয়। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় খাড়িয়া ভাষা ‘ভালনারেবল’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে। ভূমিজ জনজাতি পুরুলিয়া জেলার মোট উপজাতি জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ, মুণ্ডা ৬ শতাংশ। ভূমিজ সম্প্রদায় তামুরিয়া ভূমিজ, হলদিপুকুরি ভূমিজ, তেলি ভূমিজ, দেশি ভূমিজ ইত্যাদি শাখায় বিভক্ত। মূলত কৃষি এবং জঙ্গলে শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। ভূমিজ ভাষাকে মুণ্ডারি ভাষার একটি স্বতন্ত্র প্রকার হিসেবে গণ্য করা হয়। ভূমিজ ভাষায় ৬টি স্বরধ্বনি এবং ১৬টি ব্যাঞ্জনধ্বনি রয়েছে। অন্যান্য মুণ্ডারি ভাষার মতোই ভূমিজ ভাষায় ২০টি কার্ডিনাল সংখ্যা বর্তমান। এছাড়া পুরুলিয়া জেলায় বিরহর জনজাতি বসবাস করে যাদের ভাষা বিরহর অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত। হো ভাষার সঙ্গে এই ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। এরা মূলত জঙ্গলের উপর নির্ভর করে বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া দড়ির খাটিয়া তৈরিও এদের প্রধান জীবিকা। মুণ্ডারি দেবদেবীর মতোই সিং বোঙ্গা এবং হাপাম এদের উপাস্য দেবতা।
পুরুলিয়া জেলার জনজাতিগুলির মধ্যে ‘দিসুম সেন্দ্রা’ (শিকার উৎসব), এরখ সিম- যা ফসলের বীজ বোনার সময় সাঁওতালরা পালন করে, করম ও টুসু পরব ইত্যাদি লোকউৎসবগুলি প্রচলিত যা জেলাটিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের একটি প্রধান কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠা করেছে।
