পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

ভূমিজ সংস্কৃতি

পরবর্তীকালে ভূমিজ জনজাতির মানুষ চা শ্রমিক হিসেবে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে পরিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে বসতি স্থাপন করে; যেখানে চা বাগান অঞ্চলগুলিতে ভূমিজ ভাষার মানুষের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩০০০ জন। ভূমিজ জনগোষ্ঠীর মানুষ কতকগুলি গোত্রে বিভক্ত, যেমন- কৈত্র, গরুড়, কাসিম, ভুগাল, বাউন্দ্রা, বান, নাগ ইত্যাদি।

মানভূম অঞ্চলের ভূমিজরা বিশ্বাস করে যে, তাদের জাতিগত বৃত্তি হলো সেনাবাহিনীতে কাজ। কিন্তু পরবর্তীকালে এরা কৃষিকাজেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। জনজাতির মানুষ হিসেবে এরা জঙ্গলকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। জঙ্গলে ফাঁদ পেতে পাখি ও অন্যান্য বন্যজন্তু শিকার এবং বনজ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমেও এরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের লাল মাটিতে কৃষিকাজ ও জলসেচের সুযোগসুবিধা না থাকায় সারাবছর কৃষিকাজের সুযোগ পাওয়া যায় না। এদের মূল জীবিকা কৃষিকাজ হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ার ফলে এদের আর্থিক অবস্থা খারাপ এবং এদের নিজস্ব জমির অভাব রয়েছে। এদের প্রধান খাদ্য ভাত; তবে এরা মাংসাশী হলেও গরু বা শুকরের মাংস আহার করে না। সাদা পিঁপড়ে এবং অন্যান্য পতঙ্গও এদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত। ভাত থেকে তৈরি দেশি মদ ও মহুয়ার তৈরি মদ এদের প্রধান পানীয়।

পোশাকের ক্ষেত্রে এরা বর্তমানে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী হিন্দু ধর্মের মানুষদের অনুসরণ করে। চার-পাঁচ বছর বয়স অবধি শিশুরা নগ্ন থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে তোয়ালে অথবা পায়জামা এরা পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করে। পুরুষদের পোশাক হলো শার্ট, ধুতি, লুঙ্গি ও তোয়ালে। মহিলাদের পোশাক হলো শাড়ি ও ব্লাউজ। এছাড়া গয়না হিসেবে নাকছাবি, কানের দুল, চুড়ি ও বালা ব্যবহৃত হয়। মহিলাদের মধ্যে মাথায় ফুল পরার রীতিও বর্তমান।

ভূমিজ জনজাতির সামাজিক একক হলো পরিবার; এদের মধ্যে যৌথ পরিবার প্রথার প্রচলন নেই। এদের গোষ্ঠীর প্রধান উত্তরাধিকার সূত্রে নির্বাচিত হন। এদের সমাজ এক্সোগ্যামাস ও পেট্রিলিনিয়াল। ভূমিজরা বিভিন্ন এন্ডোগ্যামাস শাখায় বিভক্ত, যথা- তামুরিয়া ভূমিজ, হলদিপুকুরি ভূমিজ, তেলি ভূমিজ, দেশি ভূমিজ, বড়ো ভুঁইয়া, কোল ভূমিজ ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বিভাগ নিজেদের মধ্যে একএকটি এক্সোগ্যামাস গ্রুপ অর্থাৎ ‘কিলি’ গড়ে তোলে যারা নিজেদের মধ্যে বিবাহসম্পর্কে আবদ্ধ হয় না। এই ‘কিলি’ এর নামগুলি বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের নাম অনুসরণ করে দেওয়া হয়। ভূমিজরা তাদের একএকটি বিভাগ নির্দেশক প্রাণী বা উদ্ভিদকে হত্যা করে না। এদের মধ্যে প্রকৃতি ও টোটেম উপাসনার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। শিশুবিবাহ এদের মধ্যে প্রচলিত নয়। বিবাহের সময় পাত্রের পরিবার কন্যার পরিবারকে ৩ থেকে ১২ টাকা কন্যাপণ হিসেবে দেয়। সাধারণত কন্যার বাড়িতে বিবাহ সম্পন্ন হয়, যেখানে ‘মারওয়া’ নামে একটি চৌকো জায়গা প্রস্তুত করে তার মাঝখানে মহুয়া ও সিধা গাছের ডাল রাখা হয়। এদের বিবাহের ক্ষেত্রে বাঙালি ব্রাহ্মণরাই মন্ত্র উচ্চারণ করে। ভূমিজ সমাজে বিবাহপূর্ব যৌনতা সম্পর্কে কোনো সংস্কার নেই। ভূমিজ সমাজে বহুগামীতা ও বহুবিবাহেরও প্রচলন রয়েছে। প্রথম স্ত্রীর সন্তান ধারণে অক্ষমতাই এর প্রধান কারণ। ভূমিজ সমাজে বিধবাদের পূনর্বিবাহের প্রথা রয়েছে, তবে এই বিবাহ ‘সাঙা রীতি’ অনুসারে সম্পন্ন হয়। এদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের প্রথার প্রচলন থাকলেও একজন মহিলা কখনোই তার স্বামীকে বিচ্ছেদ দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী হন না। অপমানিত বা অত্যাচারিত হলে তিনি একই গোত্রের অন্য পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সাঙা পদ্ধতিতে বিবাহ করতে পারেন।

সন্তানের জন্মের সময় ঘাসি সমাজের একজন ধাইমাকে ডাকা হয়। সন্তানের জন্মের আট থেকে দশদিন পর তাকে বাড়ির বাইরে আনা হয়। তখন ধোপা ও নাপিত ডেকে জামাকাপড় পরিষ্কার করা এবং নখ ও চুল কেটে অশৌচ সমাপন করা হয়। মৃত্যুর পর ভূমিজ সমাজের রীতি অনুযায়ী মৃতদেহকে দাহ করা বা সমাধি দেওয়া- দুটি প্রথাই প্রচলিত। শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃতদেহকে সমাধি দেওয়ার রীতি রয়েছে। মৃত্যুর দশদিন পর পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করা হয়। এখানে বেশ কিছু আচার-অনুষ্ঠানের পর একটি ভোজের আয়োজন করা হয়।

ভূমিজদের চর্চা করা ধর্ম ‘সারনা’ নামে পরিচিত। ভূমিজ সমাজে ‘সিংবোঙ্গা’ ও ‘ধরম’ নামে দুইটি প্রধান দেবতার উপাসনা করা হয়। এছাড়া বৈশাখ মাসে সারহুল উৎসবের সময় ‘জাহুবুরু’ নামে দেবতার উপাসনা করা হয়। ‘কারকাটা’ নামে এক দেবীকে ফসল ভালো হওয়ার জন্য উপাসনা করা হয়। ‘বাঘুট’ বা ‘বাঘ-ভূত’, গ্রাম দেবতা এবং ‘দেওশালি’ নামক দেবতার উপাসনা কার্তিক মাসে করা হয়। এছাড়া ‘বুরু’ নামে পর্বতের দেবতাকে মাঘ মাসে উপাসনা করা হয়। বাঁকুড়া জেলার ভূমিজরা ‘পাঁচবাহিনী’ ও ‘বারাদেলা’ নামক আঞ্চলিক দেবতার উপাসনা করে। এছাড়া শ্রাবণ মাসে হিন্দু ধর্মের লৌকিক দেবতা মনসার উপাসনা করা হয়।

হিন্দু ধর্মের রীতিনীতির অনুপ্রবেশের ফলে ভূমিজ সমাজের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির ক্রমাবনমন ঘটছে। এছাড়া বাংলা, সাঁওতালি, ওড়িয়া মুন্ডারি ইত্যাদি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ও আঞ্চলিক ভাষার শব্দভাণ্ডার থেকে অনেক শব্দ ভূমিজ ভাষায় প্রবেশের ফলে বাকরীতিতেও বিমিশ্রণ ঘটছে। এই ভাষার ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গে সরকারি সুযোগসুবিধাগুলি সুনিশ্চিত করে না। এই সমস্ত কারণে ভূমিজ জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের মধ্যে নিজস্ব ভাষিক ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ ক্রমশ কমছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India- 2011

Ghosh, Binoy. 1976 Paschim Banger Sanskriti, Part-1. Pp. 423-434, Prakash bhaban

Jengcham, S. Bhumij; National Encyclopedia of Bangladesh. Asiatic Society of Bangladesh

Ol Onal; omniglot

Risley, H.H. 1892. The Tribes and castes of Bengal; Secretariat Press