পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

তাংখুল সংস্কৃতি

তাংখুল-নাগা জনজাতি মায়ানমারের পার্বত্য অঞ্চল থেকে পরিযানের মাধ্যমে তাদের বর্তমান বাসস্থান অর্থাৎ মণিপুর, নাগাল্যাণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ, অসম ও পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। তাংখুলরা মূলত আঙ্গামী, চেখসাং, জেলিয়াং, মাও, মারাম ও থাংগাল জনজাতির সঙ্গে সেনাপতি জেলার মাখেল থেকে আসে। তারা বিশ্বাস করে তাদের পূর্বপুরুষদের সাথে সমুদ্র সৈকতের সংযোগ ছিল। তাংখুলদের পরিহিত বেশিরভাগ গয়নাই যেমন- কংসাং, হুইশোন ইত্যাদি সামুদ্রিক শঙ্খ ইত্যাদির তৈরি, যা মূলত সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষরা ব্যবহার করে। তাংখুল সহ অন্যান্য নাগা উপজাতি মায়ানমার থেকে অনেক বন-জঙ্গল ও বরফাবৃত স্থান পরিভ্রমণের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করে। প্রতিটি তাংখুল গ্রাম ক্রমে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের আকার নেয়। প্রত্যেকটি গ্রামেই একটি করে অলিখিত সংবিধানের অস্তিত্ব ছিল যেগুলিতে মূলত প্রাচীন ও ঐতিহ্যাবাহী রীতিনীতিগুলি সংকলিত করা হতো। এই গ্রামগুলি লবণ ছাড়া অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে স্বনির্ভর ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে স্বীকৃত প্রতিনিধিরা শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে সহায়তা করতেন। প্রধান নির্বাচিত ব্যক্তি বিচারক, শাসক ও সেনাপ্রধান- এই তিনটি ভূমিকাই পালন করতেন। তাংখুলদের সংগঠন ‘তাংখুল লং’ এর প্রধান কার্যালয় ছিল হুনফুন যা উখরেল এর প্রাচীন নাম। তাংখুলদের বাৎসরিক মেলা, যা ‘লে খাংগাপা’ নামে পরিচিত, তা উখরুল এর সোমসাইতে অনুষ্ঠিত হতো। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও তৎকালীন বার্মা (মায়ানমার) সরকারের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে মণিপুর ও মায়ানমারের সীমানা নির্ধারিত হয়। ভারত ও মায়ানমারের স্বাধীনতা লাভের পর উভয় দেশই তাংখুল জনজাতির বাসভূমি হিসেবে স্বীকৃত হয়। বর্তমানে ভারতে ৩৮০টি এবং মায়ানমারে ৫০টি তাংখুল গ্রাম রয়েছে।

সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাংখুলরা ইম্ফল উপত্যকার মেইতেইদের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। তরোয়াল, বর্ম, তীর-ধনুক ইত্যাদির ব্যবহার তাংখুলদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। গান-নাচ ও উৎসবপ্রবণ জাতি হিসেবে তাংখুল জনজাতি পরিচিত। প্রতি ঋতুতে অন্তত একটি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যার ব্যপ্তি এক সপ্তাহ। ফসলের বীজ বপন করার সময় পালিত ‘লুরিয়া ফানিত’ হলো তাংখুলদের প্রধান উৎসব। এদের সমাজ ‘এগলিটেরিয়ান’- সকল মানুষের মর্যাদা সমান, কোন জাতি বা গোত্রবিভাগের অস্তিত্ব নেই। এদের পোষাক সাধারণত নারী বা পুরুষের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত নয়, উভয়েই ব্যবহার করতে পারে। তবে বেশ কিছু পোষাক নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথকভাবে নির্দিষ্ট। পুরুষদের জন্য নির্ধারিত কিছু বিশেষ পোষাক হলো হাওরা যা শাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মহিলাদের নির্দিষ্ট পোষাক হলো চোংখোম, লাওখা, কাহাং ইত্যাদি। এছাড়া তাংখাং, কাহাং মালাও ইত্যাদি পোষাক পুরুষ ও মহিলা উভয়েই ব্যবহার করতে পারে। তাংখুল জনজাতি পুরূষদের পোষাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘মায়োং পাশি’। এটি একটি মাথার পাগড়ি যা উৎসবের সময় ব্যবহার করা হয়। তাংখুল ভাষার নিজস্ব সংগীতের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সকল গান সব সময় গাওয়া নিষিদ্ধ। বেশ কিছু উৎসবের জন্য নির্দিষ্ট গান সেই উৎসব ছাড়া অন্য সময় গাওয়া যায় না। এসব গানের জন্য নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা হয়, যাদের মধ্যে ‘তিংতেলিয়া’ (বেহালা), ‘টালা’ (ট্রামপেট), ‘পুং’ (ড্রাম), ‘সিপা’ (বাঁশি) উল্লেখযোগ্য। এই জনজাতির নিজস্ব বিশেষ নৃত্যেরও অস্তিত্ব রয়েছে। ‘কাঠি মাহোন’ নামক বিশেষ নৃত্য মৃতের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। লুরিয়া উৎসবের সময় ‘লা খাঙ্গানুই’ নামক বিশেষ নাচ অবিবাহিত মহিলারা অনুষ্ঠান করে। যুদ্ধের নাচ ‘রাই ফেইচাক’ নামে পরিচিত।

নতুন প্রজন্মের তাংখুল নাগা যুবক ও কিশোররা ইংরেজিতে জটিলতর মনের ভাবগুলি প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হিসেবেও ইংরেজি ভাষাই প্রচলিত। নিজস্ব ভাষার অস্তিত্ব থাকলেও, ইংরেজির ব্যবহারের প্রধান কারণ হলো, তাংখুল ভাষায় সকল মনের ভাব প্রকাশক শব্দের অস্তিত্ব নেই; বিশেষত বিমূর্ত ধারণাগুলি ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে তাংখুল ভাষা অনেকসময় সহায়ক হয় না। আধুনিক, পশ্চিমি শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশ এবং পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের আধিক্যও ইংরেজি শিক্ষার জনপ্রিয়তার কারণ। তাংখুল জনজাতির নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার হার ৭৯ শতাংশ। তাংখুল নাগা জনজাতি হলো মণিপুরের প্রথম জনজাতি যারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। উরুখলে প্রথম ‘ফুংগোও ব্যাপটিস্ট চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়া মায়ানমারে বসবাসকারী তাংখুলদের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম ও এনিমিস্ট ধর্মেরও প্রচলন রয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India-2001.

Khamrang, Khayaipam. (2000) “The Tangkhul Naga Tribe between Tradition and Modernity”.

Freiberg University Press, Switzerland.

Mortensen, David. (2003) “Comparative Tangkhul” University of California, Berkeley.