ফালাম ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের তিব্বত-বর্মীয় শাখার কুকি-চীন (সেন্ট্রাল) উপশাখার একটি ভাষা, যা মূলত মায়ানমার এবং তার সীমান্তবর্তী ভারতের মণিপুর রাজ্যের চারুচন্দ্রপুর জেলা, মিজোরাম রাজ্যের অন্তর্গত লুসাই পর্বতের পার্বত্য অংশ এবং পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলার কিছু অংশে প্রচলিত। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মোট সংখ্যা ১০৭০০০। এই ভাষার প্রকারগুলির মধ্যে জানিয়াত, লাইজো, জাহাউ, লাসুন, খুয়ালসিম, লেমতে, তাপং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত প্রকারগুলিই পারস্পরিক বোধগম্যতার সূত্রে আবদ্ধ। এই ভাষাটি ‘ফালাম-চীন’ নামেও পরিচিত, যার সঙ্গে অন্যান্য সেন্ট্রাল-চীন ভাষা, বিশেষত হাখা-চীনের সাদৃশ্য রয়েছে। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই, রোমান অথবা ইংরেজি বর্ণমালা ব্যবহার করে ভাষাটির লেখ্যরূপের ব্যবহার করা হয়।

ফালাম ভাষায় ১৮টি ব্যঞ্জণধ্বনি এবং ৫টি স্বরধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে; তবে লেখার সময় ৬টি স্বরবর্ণ ব্যবহার করা হয়। এই ৫টি স্বরধ্বনির মধ্যে ৩টি ব্যাক, ১টি সেন্ট্রাল এবং ১টি ফ্রন্ট স্বরধ্বনি রয়েছে। ইংরেজি অক্ষর ব্যবহার করা হলেও Q, G, J, X- এই অক্ষরগুলির অস্তিত্ব ফালাম ভাষায় নেই। ‘ফালাম’ শব্দটি ‘ফা-হ্লাম’ শব্দ থেকে এসেছে যা ‘তাইসুন’ নামে অপর একটি চীনভাষার অন্তর্গত। খার-থুয়েন (২০০৮) এর মতে, ‘ফালাম’ কথাটি কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে বোঝায় না, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট স্থানকে বোঝায়, যেখানে ভাষাটির প্রচলন রয়েছে। তবে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ‘ফালাম’ শব্দের মাধ্যমে ভাষাটিকেও বোঝানো হয়ে থাকে। ব্যাপটিস্ট মিশনারি আর্থার এবং কাসন সর্বপ্রথম রোমান লিপি ব্যবহার করে ফালাম ভাষায় বাইবেল রচনার কাজ শুরু করেন। ফালাম ভাষার লেখ্যরূপের মধ্যে ভাওয়েল লেংথ অর্থাৎ স্বরের দৈর্ঘ্য এবং টোন- এই দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, ভাওয়েল লেংথ এবং টোন- এই দুটি বিষয়ই অন্যান্য কুকি-চীন ভাষার মতো ফালাম ভাষাতেও উপস্থিত। এখনও পর্জন্ত ফালাম ভাষার কোনো প্রামাণ্য মরফিম-বিভাগ না থাকলেও চ্যাম্পিওন (২০০৮) লিখিত ‘Chin Writer’s Handbook’ বইতে এই চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যান্য চীন ভাষার মতো ফালাম ভাষাতেও ভার্বাল-স্টেম অল্টারেশন’ এর বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। এই ভাশায় স্টপ (ভয়েসড ও ভয়েসলেস), ন্যাসাল (ভয়েসড ও ভয়েসলেস), ফ্রিকেটিভ, অ্যাফ্রিকেট, ল্যাটারাল অ্যাফ্রিকেট, ফ্ল্যাপ ও গ্লাইড স্বরধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। খার-থুয়েন যে ব্যঞ্জনধ্বনিগুলিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে ভয়েসড সোনোর‍্যান্ট এবং গ্লটাল স্টপ- এই দুটি হলো সিলেবল-ফাইনাল। খার-থুয়েন এর মতে, ফালাম ভাষায় /w/ এবং /z/- এই দুটি অ্যালোফোনের অস্তিত্ব রয়েছে। ক্লোজড অর্থাৎ রুদ্ধ ফোনিম এর ক্ষেত্রে ভাওয়েল লেংথের বিষয়টি কনট্রাস্টিভ। অসবোর্ন (১৯৭৫) এর মতে, ফালাম ভাষায় তিনটি পৃথক টোন (লো, হাই এবং লো-হাই) এর অস্তিত্ব রয়েছে। অপরপক্ষে, খার-থুয়েন এবং হাইম্যান এর মতে, ফালাম ভাষায় ৪টি পৃথক টোন ( লো, হাই, লো-হাই এবং হাই-লো) এর অস্তিত্ব রয়েছে। এদের প্রত্যেকেই ফালাম ভাষার জন্য একএকটি পৃথক ‘টোন-সন্ধি’ নিয়মের উল্লেখ করলেও এই নিয়মগুলি অনেকক্ষেত্রেই পরস্পরের সাথে ওভারল্যাপ করে। অসবোর্ন ফালাম ভাষায় তিনপ্রকার ‘ভ্যালেন্স-রেইজিং অপারেশন’ এর কথা উল্লেখ করেছেন- কজেটিভ, বেনিফ্যাক্টিভ এবং কমিটেটিভ গঠন। অসবোর্ন ফালাম ভাষার ক্রিয়াগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন- রিজিড টোন ক্লাস, স্টেম ডিস্টিংগুইশিং ক্লাস এবং টোনলেস ক্লাস। টোনলেস ক্লাসের ক্রিয়াগুলিতে হাই বা লো- যেকোনো একটি টোনের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী। স্টেম ডিস্টিংগুইশিং ক্লাসের ক্রিয়াগুলিতে প্রথম স্টেম এ হাই- লো এবং দ্বিতীয় স্টেম-এ লো-হাই- এরকম টোনাল ডিস্ট্রিবিউশন থাকে। টোনলেস ক্লাসের ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত ফর্মটি টোনবিহীন হলেও পূর্ববর্তী সিলেবল অনুযায়ী হাই বা লো টোন গ্রহণ করে। এছাড়া মিক্সড ক্লাস এবং রাইজিং টোন ক্লাস নামে অপর দুটি শ্রেণির অস্তিত্ব ফালাম ভাষায় রয়েছে। ভার্ব-স্টেম অল্টারেশনের সময় এই সমস্ত টোন পরিবর্তনের বিষয়গুলি লক্ষ্য করা যায়। খার-থুয়েন পাঁচ প্রকার ভার্ব-স্টেম অল্টারেশনের কথা উল্লেখ করেছেন- ন্যাসাল অল্টারেশন, স্টপ অল্টারেশুন, গ্লটালাইজেশন, ভাওয়েল শর্টেনিং এবং ভাওয়েল কোলেসেন্স।

গ্রন্থপঞ্জী :