১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মনপা জনজাতির বাসভূমি ব্রিটিশদের মধ্যে আগ্রহ জাগায়। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম তিব্বত ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা অঙ্কন করলে মনপাদের বাসভূমিটিও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মনপা জনজাতির মূল জীবিকা কৃষিকাজ হলেও পার্বত্য অঞ্চলের অনুর্বর মৃত্তিকা এবং জলসেচ ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ার কারণে সারাবছর কৃষিকাজ সম্ভব হয় না। ফলে গবাদি পশু পালনকেও এরা জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। চমরি গাই, শুকর, ভেড়া ও মুরগি পালনের মাধ্যমেও এরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে ভুট্টা, গম, বার্লি, মিলেট ইত্যাদির চাষও এরা করে থাকে। এছাড়া মনপা জনজাতি কাঠের কাজ, থাংকা অঙ্কন এবং কার্পেট তৈরিতে পারদর্শী। এছাড়া এরা বিভিন্ন স্থানীয় গাছের ছাল থেকে কাগজ তৈরিতেও দক্ষ। তাওয়াং মঠে একটি ছাপাখানা রয়েছে, যেখানে মনপা জনজাতির ধর্মীয় গ্রন্থগুলিকে এই স্থানীয় কাগজে কাঠের ব্লক ব্যবহার করে ছাপা হয়। এছাড়া বাঁশের কাজ এবং ঝুড়ি নির্মাণেও মনপা জনজাতির মানুষ দক্ষতা অর্জন করেছে।
মনপা জনজাতির প্রধান পালিত উৎসবগুলি হলো ‘চোসকার’- ফসল বোনার উৎসব, ‘লোসার’ ও ‘তোরগা’। ‘লোসার’ উৎসবের সময় এই জনজাতির মানুষ তাওয়াং মঠে আগত তিব্বতি নববর্ষের জন্য প্রার্থনা জানায়। এছাড়া ‘আজিলামু’ নামক উৎসবে ‘প্যান্টোমাইম’ নাচ এই জনজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক। চোসকার’ উৎসবের সময় বৌদ্ধ লামারা গুম্ফায় বসে ধর্মীয় গ্রন্থগুলি পাঠ করেন। তারপর গ্রামবাসীরা চাষের জমির চারপাশ পরিভ্রমণ করে। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো ভালো ফসল উৎপাদন, ফসলকে বন্য জন্তু ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করা এবং গ্রামের সমৃদ্ধি।
মনপা সমাজে বাঘ এবং মানুষ ছাড়া সমস্ত প্রাণীকেই শিকার করা চলে। কেবলমাত্র কোনো উৎসবের দিনে কেবলমাত্র একজন ব্যক্তিই বাঘ শিকার করতে পারেন। বাঘ হত্যা করার পর তার দাঁতগুলি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মনপা সমাজ বিশ্বাস করে যে, ঐ বাঘের দাঁত ওই ব্যক্তিকে সমস্তরকম বিপদ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম।
মনপাদের সমাজ ছয়জন ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেটি ‘ট্রুকদ্রি’ নামে পরিচিত। এই পরিষদের সদস্যরা ‘কেনপো’ নামে পরিচিত। মনপা সমাজে লামাদের সম্মনের আসনে বসানো হয়। দুজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ‘নেতসাং’ এবং অপর দুজন ‘জংপেন’ নামে সম্মানীয় আসনের অধিকারী। মনপা সমাজের বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করে, অন্য ধর্মের প্রভাব খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। মনপা সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, অর্থাৎ একজন পুরুষই পরিবারের প্রধান হিসেবে বিবেচিত হন। সন্তান লাভের ক্ষেত্রে পুত্র বা কন্যার উপর আলাদা কোনো বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
মনপাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘চুবা’ নামে পরিচিত, যা প্রকৃতপক্ষে একটি তিব্বতীয় ঘরানার পোশাক। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই ‘ইয়াক’ অর্থাৎ চমরি গাইয়ের লোম থেকে তৈরি একটি বিশেষ পোশাকে মাথা ঢেকে রাখে। মহিলাদের মধ্যে রুপো এবং কোরাল অর্থাৎ প্রবাল নির্মিত গয়না জনপ্রিয়। এছাড়া অনেকসময় একটি ময়ূরপালক যুক্ত টুপি পরার প্রচলন রয়েছে। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের শীতল আবহাওয়ার জন্য মনপা জনজাতির বাড়িগুলি প্রধানত কাঠ ও পাথরের তৈরি হয়, এবং বাড়ির ছাদ বাঁশ দিয়ে নির্মিত হয়, যা শীতকালে বাড়িকে গরম রাখতে সাহায্য করে।
Blench, R. 2014. Sorting out Monpa: The relationships of the Monpa languages of Arunachal Pradesh.
Census of India-2011
Ved Prakash. 2007. Encyclopedia of North-east India, Vol. 3; Atlantic Publishers and Distributors.
Winds of Change: Arunachal in Tradition and Transition.