জৌ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো ‘পাহাড়', অর্থাৎ এই শব্দটি এই জনজাতিকে পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। ভারতে এদের মণিপুরে বসবাসকারী ৩৩টি আদিবাসী জনজাতির মধ্যে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্রিটিশ শাসনকালের আগে জৌ এবং পাইতে এই দুটি জনজাতি একটি একক বৃহত্তর জনজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলো বলে মনে করা হয়। এদের সমাজ মূলত পিতৃতান্ত্রিক। এদের মধ্যে ক্ল্যান-এক্সোগ্যামি প্রচলিত, অর্থাৎ দুই ভিন্ন গোত্রভুক্ত পুরুষ ও মহিলার মধ্যে বিবাহই স্বীকৃত। বিবাহের পর কন্যাসন্তানকে স্বামীর বাড়িতে অবস্থান করতে হয় এবং সন্তানরা স্বামীর পদবি গ্রহণ করে। পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তির উত্তরাধিকার জ্যেষ্ঠপুত্রের হাতে অর্পিত হয়। বিবাহের পূর্বে অবিবাহিত অবস্থায় জৌ জনজাতির যুবক এবং যুবতীরা ‘আইসান' নামে একটি প্রচলিত প্রথা পালন করে থাকে। এটির পালনের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা হয় যে, যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে তা পুত্র ও কন্যা উভয়ের পক্ষে শুভ অথবা অশুভ। এছাড়া এই সংক্রান্ত আরও অনেকরকম বিশ্বাস জৌ জনসমাজে প্রচলিত রয়েছে; যেমন- ‘দেইতুহসান', ‘কুমথেই-সান', ‘সি-সান’, ‘বুসান', ‘মাং-সান' ইত্যাদি। জৌ জনজাতি ‘পেট্রিলিনিয়াল ক্রস কাজিন ম্যারেজ’-এ বিশ্বাসী। এই সমাজে মূলত তিনপ্রকার বিবাহ হয়ে থাকে-
১) তং-মৌ অর্থাৎ সম্বন্ধ করে বিবাহ
২) নেইলা অর্থাৎ ক্রস-কাজিন ম্যারেজ
৩) বলপুর্বক বিবাহ
এদের বিবাহ অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত বেশ কয়েকটি প্রথা রয়েছে। যেমন- ‘জু-উম-কোইহ’ অর্থাৎ পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে বিবাহের পূর্বে একটি ‘প্রি-এনগেজমেন্ট কন্ডিশন’ স্থির করা হয়, যেখানে কন্যার পিতাকে ২টাকা এবং দেশি মদ প্রদান করা হয়। এই প্রি-এনগেজমেন্ট ভেঙে গেলে কুড়ি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার প্রথা রয়েছে। এই প্রথাটি ‘নেইতা-মান' নামে পরিচিত। এছাড়া এদের সমাজে ‘মৌলুও’ নামক প্রথার মাধ্যমে বড়ো ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে ছোটভাই বিবাহ করতে পারে। ‘নুমেই-ফুঙ্গিকা' নামে অপর একটি প্রথা জৌ সমাজে প্রচলিত, যার মাধ্যমে কোনো মহিলার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি যদি স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে চলে যান, তাহলে স্বামীর সম্পত্তির অংশ থেকে তার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এই সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের প্রথাটি ‘কিখুল' নামে পরিচিত। স্বামী এবং স্ত্রী-উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এই বিচ্ছেদ অনুষ্ঠিত হয়। জৌ সমাজ মূলত মনোগ্যামাস অর্থাৎ একগামী।
কৃষিকাজই এদের প্রধান জীবিকা। প্রধানত ঝুমচাষ ও পাহাড়ের গাইয়ে ধাপ কেটে ধান ও ভুট্টার চাষের মাধ্যমে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। তবে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জনজাতি হওয়ার কারণে জৌ জনজাতির অধিকাংশ মানুষের নিজস্ব জমি নেই। পশুপালন এবং জঙ্গল থেকে বনজ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমেও এরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। মণিপুর ও মিজোরাম রাজ্য থেকে ব্রিটিশ শাসনকালে মূলত চা-শ্রমিক হিসেবে জৌ জনজাতির মানুষ অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের চা-বাগানগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চা-শ্রমিকের বৃত্তিও এদের একটি অন্যতম প্রধান জীবিকা। এরা প্রধানত স্টক-মোঙ্গলয়েড গোত্রীয়, চোখ ছোট, নাক চ্যাপ্টা ও খর্বকায়। বর্তমানে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানধর্ম এদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও জৌ জনজাতির প্রাচীন ধর্ম ছিলো অ্যানিমিজম-নির্ভর, যেখানে টোটেম উপাসনার প্রথা প্রচলিত ছিলো। এই জনজাতি ডেভিল অর্থাৎ অপদেবতার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করে। এই জনজাতি বেশ কয়েকটি গোত্র ও উপগোত্রে বিভক্ত। এদের মধ্যে বর্তমানে খ্রিসটানধর্মের অধিক জনপ্রিয়তা থাকলেও এরা জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহের অনুষ্ঠানগুলি প্রাচীন-ধর্মের রীতি মেনে পালন করে। ফলে গুরুং জনজাতির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার-আচরণে একটি মিশ্রিত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়।
এই জনজাতির নিজস্ব উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান ও পোশাকের ঐতিহ্য রয়েছে। জনজাতির মানুষ মূলত দ্বিভাষিক অথবা ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিভাষিক। রেংমা ছাড়াও নাগামিজ, মণিপুরি, ইংরেজি, অসমীয়া এবং বাংলা ভাষাতেও এরা পারদর্শী। মূলত লেখাপড়া এবং কাজের সুযোগসুবিধার কারণে এরা সরকারি ভাষাগুলির ব্যবহারে অধিক আগ্রহী। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে এদের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য-সবক্ষেত্রেই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পাইতে ভাষার সঙ্গে অত্যধিক সাদৃশ্যের কারণে এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত নৈকট্যের কারণে অনেকসময় দুটি পৃথক ভাষার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিমিশ্রণ ঘটে। ফলে দুটি ভাষাই একে অপরের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া কোড-সুইচিং ও কোড-মিক্সিং এর প্রবণতার ফলেও অন্যান্য ভাষার অনেক শব্দ জৌ ভাষায় প্রবেশ করছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথাসমূহের লিখিত উপায়ে সংরক্ষণ না করার ফলে এবং চর্চার অভাবে প্রাচীন প্রথাগুলি অনেকাংশে বিস্মৃত হচ্ছে। তবে নিজস্ব লিপির উদ্ভব, প্রসার এবং এটির ব্যবহারে আগ্রহ বৃদ্ধির ফলে এদের সংরক্ষণ কিছুটা হলেও সম্ভব হয়েছে। এই ভাষার ব্যবহার বর্তমানে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
Census of India- 2011
Singh, C.Y. & Himmat, L. 2013. Zou Phonology. Language in India
Pandey, A. 2010. Introducing the Zoo Script
Thanglienmang, Dr. P. Genetic Classification of the Zo Language and overview of Kuki-Chin languages
Thanglienmang, Dr. P. 2012. A Descriptive Grammar of the Zo language. academia.edu
Zou, www.ethnologue.com