ফোম ভাষা
ফোম হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাগোষ্ঠীর ব্রহ্মপুত্র শাখার কোনয়াক উপশাখার একটি ভাষা, যা মূলত নাগাল্যাণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত লংলেন জেলার ৩৬টি গ্রামের অধিবাসীরা ব্যবহার করে থাকেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে প্রায় ৫৪৪১৬জন মানুষ মাতৃভাষা হিসেবে ফোম ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। এই ভাষাটি আসিরিংগিয়া, চিংমেংগু, ফোন, তামলু এবং তামলু-নাগা নামেও পরিচিত। ভাষাটি মূলত অরুণাচল প্রদেশ ও নাগাল্যাণ্ডের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে ব্যবহৃত হয়। এই অঞ্চলটিতে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে বেশ কয়েকটি ভাষা ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে। অরুণাচল প্রদেশ অংশে টাংসা, নকটে ও ওয়ানচো ভাষা এবং নাগাল্যাণ্ড অংশে কোনয়াক, ফোম ও চাং ভাষা সন্নিবিষ্ট অবস্থায় অবস্থান করে। ফোম ভাষা মূলত একটি মৌখিক ভাষা, এর কোনো নিজস্ব লিপির অস্তিত্ব নেই। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অংশে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও আলিপুরদুয়ার জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ফোম ভাষা ব্যবহারকারী মানুষজন বসবাস করেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার নিরিখে ফোম ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা এক শতাংশেরও কম।
শেফার (১৯৫৫) এবং অন্যান্য বেশ কিছু ভাষাতাত্ত্বিকরা এই উত্তর-নাগা ভাষাগুলির সঙ্গে বোড়ো-কোচ শাখার ভাষাগুলির সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। এই উত্তর-নাগা ভাষাগুলির সঙ্গে অন্য ভাষাগুলির তুলনামূলক আলোচনা এই ভাষাগুলির সম্পর্কে অপ্রতুল ধ্বতিতাত্ত্বিক তথ্যের কারণে ব্যাহত হয়েছে। নাগরাজ (১৯৯৪) সর্বপ্রথম এই উত্তর-নাগা ভাষাগুলির ফোনোলজি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন; যেখানে এই ভাষাগুলিতে ব্যবহৃত টোনগুলিকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে তার বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য অনেক ভাষার মতো ফোম ভাষাকে একটি টোনাল ভাষা বলা দুরূহ। এই ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি মূলত প্রারম্ভিক ব্যঞ্জনধ্বনি তথা ইনিশিয়াল কনসোনেন্ট, স্বরধ্বনি, অন্তিম ব্যঞ্জনধ্বনি অর্থাৎ ফাইনাল কনসোনেন্ট এবং টোন-এই চারটি বিষয়ের নিরিখে বিচার করা যায়। ফোম ভাষার বেশিরভাগ শব্দই মনোসিলেবিক অর্থাৎ একদলবিশিষ্ট এবং এখানে খুব সহজেই মিনিমাল পেয়ার-এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়- যেগুলি থেকে ফোনোলজিকাল কনট্রাস্ট এর বিষয়টির সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। ফোম ভাষায় শব্দের শুরুতে এবং শেষে কোনো কনসোনেন্ট ক্লাস্টার না বসলেও শব্দের মধ্যবর্তী স্থানে কনসোনেন্ট ক্লাস্টার বসতে পারে। এই শব্দমধ্যস্থ কনসোনেন্ট ক্লাস্টারগুলি মূলত একটি সিলেবলের শেষ ব্যঞ্জন এবং অপর সিলেবল এর প্রথম ব্যঞ্জন সহযোগে গঠিত হয়। ধ্বনির অ্যাসিমিলেশনের প্রবণতাও ফোম ভাষার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ফোম ভাষায় তিন শ্রেণির স্টপ কনসোনেন্ট এর অস্তিত্ব রয়েছে- ভয়েসলেস, অ্যাসপিরেটেড ও আনঅ্যাসপিরেটেড। এগুলি বাইলেবিয়াল, অ্যাপিকাল ও ভেলার- এই তিনটি স্থানে বসতে পারে। শব্দের শুরুতে ব্যবহৃত আনঅ্যাসপিরেটেড স্টপগুলি ইংরেজি ভাষার ভয়েসড স্টপগুলির তুলনায় কম ভয়েসড। ফোম ভাষার ভয়েস অনসেট টাইম ইংরেজির চেয়ে গড়পড়তাভাবে বেশি। ফোম ভাষার স্বরধ্বনিগুলি ঐ ভাষার ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি এবং টোনগুলির থেকে অধিকতর কঠিন। এই ভাষায় ১০টি স্বরধ্বনি এবং ৬টি ডিপথং এর অস্তিত্ব রয়েছে। এই ভাষায় টোন বৈশিষ্ট্যটি খুব স্পষ্টভাবে দেখা না গেলেও রাইজিং, ফলিং ও লেভেল- এই তিপ্রকার টোন খুঁজে পাওয়া যায়। বেশ কয়েকটি ইন্ট্রাঞ্জিটিভ ভার্ব অর্থাৎ অকর্মক ক্রিয়ার কজেটিভ ও ট্রাঞ্জিটিভ ভ্যারিয়েন্ট বর্তমান, যেগুলিকে কেবলমাত্র টোনের ভিত্তিতে পৃথক করা যায়। পলিসিলেবিক অর্থাৎ বহুদলবিশিষ্ট শব্দের ক্ষেত্রে অ্যাসিমিলেশনের প্রবণতা এই ভাষায় লক্ষ্যণীয়। এই ঘটনা মূলত সিলেবল-বাউণ্ডারিগুলিতেই ঘটে। এই ঘটনা মূলত কম্পাউণ্ড অর্থাৎ যৌগিক শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যখন উক্ত যৌগিক শব্দগুলি কোনো মনোসিলেবল অর্থাৎ একদল থেকে সৃষ্টি হয়; এবং যে মরফিমগুলি স্বাধীন শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে তাদের ক্ষেত্রে। যে স্টপ ব্যঞ্জনগুলি প্রকৃতিগতভাবে স্বল্পমাত্রায় ভয়েসড বা আনভয়েসড, তারা যখন কোনো ভয়েসড ফোনের পরে বসে তখন তারা পূর্ণাঙ্গমাত্রায় ভয়েসড ফোনে পরিণত হয়। আরও জটিল একটি অ্যাসিমিলেশনের উদাহরণ হলো, যখন একটি সিলেবলের ফাইনাল ন্যাসাল অর্থাৎ নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনির পর এমন একটি সিলেবল থাকে যেটি অন্তত তাত্ত্বিকভাবে এমন একটি ফর্ম থেকে আসে যেখানে কোনো ইনিশিয়াল কনসোনেন্ট অর্থাৎ ব্যঞ্জনধ্বনি নেই। এছাড়া ফোম ভাষায় বেশ কয়েকটি রাইমের অস্তিত্ব রয়েছে। মরিসন (১৯৬৭) এবং ফ্রেঞ্চ (১৯৮৩) ফোম ভাষায় সর্বপ্রথম একটি ফোনিম ইনভেনটরি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, যেটি কুমার প্রথম প্রকাশ করেন।
রাই গোত্রীয় ভাষাগুলির মধ্যে অনেকে ইনক্লুসিভ ও এক্সক্লুসিভ সর্বনামের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করে। সর্বনামের ক্ষেত্রে স্বাধীন ব্যক্তিবাচক সর্বনাম এবং অনুসর্গযুক্ত পজেসিভ সর্বনামের ব্যবহার দেখা যায়। এই ভাষায় দুই প্রকার ক্রিয়ার কাল আছে- অতীত এবং অনতীত (নন-পাস্ট)। এছাড়া ভাষাগুলিতে একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন- এই তিন প্রকার বচনের অস্তিত্ব রয়েছে। থার্ড পার্সন অর্থাৎ প্রথম পুরুষে জেন্ডার অর্থাৎ লিঙ্গসূচক কোনো মার্কিং থাকে না। বিশেষ্যটি জীব অথবা জড়- এই ধর্মের উপর নির্ভর করে নমিনাল অর্থাৎ সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে কোয়ালিফায়ার বসে। এই ভাষাগুলির সাধারণ বাক্যক্রম হলো সাবজেক্ট-অবজেক্ট-ভার্ব অর্থাৎ ক্রিয়া ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের মতোই বাক্যের শেষে বসে। এই ভাষাগুলি মডিফায়ার-হেড, অর্থাৎ এখানে মডিফায়ার অবশ্যম্ভাবীরূপে হেড এর পূর্বে বসে। এর্গেটিভ-ইন্সট্রুমেন্টাল, জেনিটিভ, কমিটেটিভ, লোকেটিভ এবং অ্যাবলেটিভ কেসের অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়া কিছু বিশেষ ভাষায় ‘অল্টিটিউডিনাল’ নামক বিশেষ কেসের অস্তিত্ব রয়েছে, যেটি হাই, লো ও লেভেল টোনকে সূচিত করে। কিছু কিছু ভাষায় ‘স্প্লিট-এর্গেটিভিটি’ও দেখা যায়। লিঙ্গ ও বচন সূচিত করতে সাবজেক্ট-ভার্ব এগ্রিমেন্টের অস্তিত্ব এই ভাষাসমূহে রয়েছে। এছাড়া রিদুপ্লিকেশনের মাধমে ভার্ব-স্টেমের সম্প্রসারণও ভাষাগুলিতে ঘটে থাকে; তবে সেক্ষেত্রে রিডুপ্লিকেটেড অংশের কোনো স্বাধীন অর্থের অস্তিত্ব থাকে না।
গ্রন্থপঞ্জী :
Census of India- 2011
Buling, R; & Phom, A; Phom Phonology and Word List
Frech, W. 1983; Northern Naga:A Tibeto-Burman Mesolanguage; Ph.D. Thesis, City University of New York
Marrison, G. 1967; The Classification of Naga Languages of North-East India; Ph.D.Thesis, University of London
Nagaraja, K.S. 1994; Konyak-Hindi-English Dictionary; CIIL, Mysuru