পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

রাই সংস্কৃতি

কিরান্তি-রাই জনজাতির আদি বাসস্থান নেপাল। পরিযানের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনকালে চা-শ্রমিক হিসেবে এরা ভারতের পুর্ব ও উত্তর-পুর্বাংশের রাজ্যগুলিতে (মূলত সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্স পার্বত্য অঞ্চল) ছড়িয়ে পড়ে। রাই জনজাতির মানুষ প্রধানত মোঙ্গলয়েড আকৃতির, কণ্ঠার হাড় উঁচু, চ্যাপ্টা নাক, চোখ ছোট। উন্নত স্বাস্থ্যের অধিকারী এবং উচ্চতা মাঝারি। এদের প্রধান উৎপন্ন ফসল ধান ও ভুট্টা। প্রধানত পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ ও ঝুম চাষের মাধ্যমে এই জনজাতি জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া জাদ, রাক্সি, তোংবা ইত্যাদি দেশি মদের প্রচলন রয়েছে। রাই জনজাতির প্রকৃত নাম হলো ‘খাম্বু’।

কিরান্তি-রাই জনগোষ্ঠীর প্রধান পালিত ধর্মীয় রীতি হলো ‘ছাছুওয়া’, যা প্রতি বছর ভাদ্রমাসে পালিত হয়। গোমাংস এই রীতি পালনের অন্যতম প্রধান উপকরণ হলেও বর্তমানে এদের আদি বাসভূমি নেপালে গোমাংস নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে এই প্রথার অনুশীলন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চালের ভাত এবং ‘জাদ’ নামক দেশি মদ এই উৎসবের অপর প্রধান উপকরণ। এই প্রথা তথা রীতির মাধ্যমে একটি মুরগি কেটে তার রক্তকে মৃত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। নতুন ফসল ওঠার পর তা পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ না করে রাই জনজাতি তা ব্যবহার করে না। রাই জনজাতির প্রধান পুরোহিত হলেন ‘মাংপা’, যিনি এই সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান পালনের পর অংশগ্রহণকারী সমস্ত মানুষের মধ্যে রান্না হওয়া জিনিসপত্র ভাগ করে দেন। এছাড়া ‘মাং’ উৎসবটি মাঘ মাসে ফসল কেটে ঘরে তোলার পর প্রকৃতির উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পালিত হয়। এই উৎসবে গৃহদেবতা ও পূর্বপুরুষের উপাসনা এবং সবশেষে ‘সাতনামচিঙ্কো’ নামে এক বিশেষ সাপের উপাসনা করা হয়। এছাড়া রাই জনজাতি ‘হোংকু মাং’ নামে নদী ও জলের দেবতারও উপাসনা করে। রাই জনজাতির একটি বিশেষ প্রথা হলো স্ব-উপাসনা অর্থাৎ ‘বাকতাংচুক’। ‘উভাওলি’ উৎসব ফসল বোনার সময় এবং ‘উধাওলি’ উৎসব ফসল কাটার সময় এই জনজাতি পালন করে। এছাড়া ‘সাকেওয়া’ উৎসবে প্রকৃতি এবং দেবতার উপাসনার রীতি রয়েছে। এটি ‘বালিপূজা’ অথবা ‘চণ্ডীপূজা’ নামেও পরিচিত। এই উৎসবের উপকরণ হিসেবে দেশি মদ, ভুট্টা ও ধানবীজ, মোরগ ও শুকরছানা ব্যবহার করা হয়। এদের রক্ত পৃথিবী এবং অন্যান্য উপাস্য দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়।

রাই জনজাতি পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে লেপচা, তামাং লিম্বু প্রভৃতি জনজাতির পাশাপাশি বসবাস করে। এছাড়া রাই ভাষা হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো একটি ভাষাকে চিহ্নিত না করা যাওয়ার কারণে এই ভাষাগুলিতে প্রতিনিয়ত অন্যান্য ভাষার শব্দ ও বাকরীতির অনুপ্রবেশ ঘটে। চাকরি ও অন্যান্য সরকারি সুযোগসুবিধা লাভের আশায় রাই জনজাতি হিন্দি, নেপালি, বাংলা ইত্যাদি সরকারি ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। ফলে এদের নিজস্ব ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। লিখিত রূপের অভাবও রাই গোষ্ঠীর ভাষাসমূহের অবলুপ্তির অপর একটি প্রধান কারণ। এছাড়া এদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি অনুশীলন করা পুরোহিতের সংখ্যাও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এদের মধ্যে ক্রমশ বৌদ্ধ ধর্মেরও প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে সমগ্র কিরান্তি-রাই জনজাতিরই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের একটি সুনির্দিষ্ট প্রবণতা রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মের হাত ধরে পশ্চিমি ভাবধারা ও ইংরেজি শিক্ষা এই জনজাতির মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই সমস্ত কারণে রাই জনজাতির ভাষা-সংস্কৃতি ক্রমশ নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India, 2011

Census of Nepal, 2001

Kiranti (Rai); Endangered Language Alliance

Muluki Ain. Bauddhik Darpan, Kathmandu

Rai, T.B. Kiranti Raiharku bare, Kirant Rashtriya Yuva Samaj

Rai, P.K. Influence of Political Changes in the Rituals of Kiranti Rai Community.