লামবাডি ভাষা

লামবাডি ভাষা ভারতের নোম্যাডিক শ্রেণিভুক্ত বানজারা জনগোষ্ঠীর মানুষের ব্যবহৃত ভাষা, যারা প্রধানত উত্তর-পশ্চিম ভারতের বাসিন্দা হলেও বর্তমানে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাষাটি "লাবাঙ্কি" অথবা "গড়-বোলি" নামেও পরিচিত। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের ভারতীয়-আর্য শাখার পশ্চিমা উপশাখার একটি ভাষা। তবে বর্তমানে পূর্বভারতে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাতেও বানজারা জনজাতির মানুষের বসবাস গড়ে উঠেছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই জনজাতির মানুষের মোট জনসংখ্যা ৪৮৫৭৮১৯।

এই ভাষার আঞ্চলিক প্রকারভেদগুলি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা ইত্যাদি রাজ্যভেদে এই জনজাতির মানুষের মুখের ভাষায় বেশ কিছু আঞ্চলিক রূপভেদ দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও এই ভাষার একটি নিজস্ব রূপ গড়ে উঠেছে। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই। বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বানজারা জনজাতির মানুষ যথাক্রমে মারাঠি, কন্নড়,তেলুগু, তামিল, বাংলা ইত্যাদি লিপিগুলি লেখার কাজে ব্যবহার করে। এটিমোলজির দিক থেকে দেখলে এই লামবাডি ভাষা মূলত একটি পশ্চিম-রাজস্থানী ভাষা। এই ভাষার একটি প্রধান প্রকার হলো লামানি, রাজ্যভেদে যার আবার বিভিন্ন রূপ রয়েছে। বানজারা জনজাতির মানুষ নিজেদের ‘গড়' বা ‘কর' নামে অভিহিত করে। এই শব্দের সঙ্গে জড়িত অপর একটি শব্দ হলো ‘গড় মাটি’ অথবা ‘গড়মাটি’। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে, ‘বানজারা' শব্দটি সংস্কৃত ‘বণিজ' বা ‘বণিক' শব্দ থেকে এসেছে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ নিখিল ভারত বানজারা সেবা সংঘ নামে একটি সংগঠন একটি সমীক্ষা করে, যেখানে এই বানজারা জনজাতির অন্তর্গত ১৭টি উপশাখার সন্ধান পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপশাখা হলো চরণ, ধারিয়া, মাথুরিয়া, কোলহাটি, মুখেরি ইত্যাদি।

লামবাডি ভাষায় ৭টি স্বরধ্বনি রয়েছে। এদের মধ্যে ফ্রন্ট, সেন্ট্রাল ও ব্যাক- এই তিনপ্রকার স্বরধ্বনি থাকলেও মিড-সেন্ট্রাল স্বরধ্বনি লামবাডি ভাষায় নেই। বানজারা ভাষায় দুটি ফ্রন্ট এবং দুটি ব্যাক স্বরধ্বনি রয়েছে। এই ভাষার একমাত্র সেন্ট্রাল স্বরধ্বনিটির প্রকৃতি হলো লো। বানজারা ভাষার ভাওয়েল-ইনভেন্টরি তথা স্বরধ্বনির তালিকায় এমন দুটি ধ্বনি রয়েছে, কম ব্যবহারের কারণে যাদের এই তালিকায় স্থান দেওয়া হয়নি। কিন্তু এদের পৃথক স্বরধ্বনি হিসেবে গণ্য করার কারণ হলো, এই দুটি স্বরধ্বনি অন্য স্বরধ্বনিগুলির চেয়ে উচ্চারণের নিরিখে যথেষ্ট পার্থক্য বজায় রাখে। /I/ এবং /u/ এই স্বরধ্বনিগুলি হাই-ফ্রন্ট এবং হাই-ব্যাক ভাওয়েল এবং এরা কার্ডিনাল স্বরধ্বনি হিসেবেও স্বীকৃত। দীর্ঘ এবং হ্রস্ব উভয়প্রকার স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে ন্যাসালাইজেশনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভাওয়েল-লেনদেনিং এর বিষয়টি দুটি স্বরধ্বনি ছাড়া অন্য সব স্বরধ্বনিতেই দেখা যায়। এছাড়া এই ভাষায় মোট ৩০টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে। ব্যঞ্জনধ্বনিগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- অবস্ট্রুয়েন্ট ও সোনোর‍্যান্ট। প্রথম শ্রেণিতে স্টপ ও ফ্রিকেটিভ ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি রয়েছে। স্টপ ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির মধ্যে ভয়েসলেস-আনঅ্যাসপিরেটেড, ভয়েসলেস-অ্যাসপিরেটেড, ভয়েসড-আনঅ্যাসপিরেটেড এবং ভয়েসড-অ্যাসপিরেটেড- এই ৪টি শ্রেণি দেখা যায়। দুটি ফ্রিকেটিভ ব্যঞ্জনধ্বনি এই ভাষায় রয়েছে যেগুলি ভয়েসলেস। এই ভাষায় বচনের সংখ্যা দুই- একবচন ও বহুবচন। কোনো বিশেষ্যের একবচন থেকে বহুবচনে রূপান্তত্রের সময় ওই আনমার্কড বিশেষ্যের শেষে মার্কিং এর কোনো পরিবর্তন হয় না; তবে উক্ত বিশেষ্যের পূর্বে সংখ্যাবাচক বিশেষণ বসিয়ে তাকে বহুবচনে রূপান্তরিত করা হয়। এই সমস্ত বিশেষ্যের অ্যাবসোলিউটিভ প্লুরালের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। লামবাডি ভাষায় প্রধানত দুই প্রকার লিঙ্গ- পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গের ব্যবহার রয়েছে। তবে এই ভাষায় লিঙ্গ-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ফোনোলজিকাল বা মরফোলজিকাল নিয়ম মানা হয় না। এই ভাষায় ৬টি কেস তথা কারক-সম্পর্ক স্বীকৃত। বিশেষ্য তথা নাউন-স্টেমের পর কেস-সাফিক্স বসিয়ে এই কারক-সম্পর্কগুলি নির্দেশ করা হয়। একবচন এবং বহুবচন- উভয়ক্ষেত্রে সমপ্রকার কেস-সাফিক্স ব্যবহার করা হয়। সমস্ত বিশেষ্য সাধারণ অবস্থায় নমিনেটিভ ফর্মে আনমার্কড অবস্থায় থাকে। অ্যাকুইজিটিভ এবং ডেটিভ কেস-এর ক্ষেত্রে /n/ এবং /e:n/ এই দুটি ফোনিম ব্যবহৃত হয়। এই দুটি অ্যালোফোন ফোনোলজিকালি কন্ডিশনড অবস্থায় থাকে। এগুলি ছাড়াও লামবাডি ভাষায় ইন্সট্রুমেন্টাল, পজেসিভ এবং লোকেটিভ- এই তিনপ্রকার কেস-এর অস্তিত্ব রয়েছে। পজেসিভ কেসের ক্ষেত্রে /r/ এবং /e:r/ এই দুটি ফোনোলজিকালি কন্ডিশনড অ্যালোমর্ফ ব্যবহার করা হয়। লোকেটিভ কেসের ক্ষেত্রে /ma~e:ma/ এই দুটি অ্যালোমর্ফের ব্যবহার রয়েছে। কেস-মার্কার ছাড়াও লামবাডি ভাষায় বেশ কিছু পোস্ট-পজিশনের ব্যবহার রয়েছে। অ্যাসোশিয়েশন এবং লোকেশন- এই দুটি বিষয় পোস্ট-পজিশনের ব্যবহার করে বোঝানো হয়। যেসমস্ত বিশেষ্যের ক্ষেত্রে পজেসিভ-কেস সাফিক্স ব্যবহার করা যায় না, সেই সমস্ত ক্ষেত্রে পোস্ট-পজিশন ব্যবহার করা হয়।

গ্রন্থপঞ্জী :

Banjara Lifestyle and Community; 2020. International Research Journal of Multidisciplinary Scope

Languages of Tamil Nadu: Lambadi: AN INDO-ARYAN DIALECT. Census of India-1961. Vol: 9.

Census of India- 2011

Singh, K.S.et al. People of India, Sikkim, Anthropological Survey of India. Seagull Books, 1993.

Naik Mood, Dr. D. & Dhananjay, Dr. S. 2020. Gor Banjara - An Enduring Tribe. p. 263

Trail, R.L. 1970. The Grammar of Lamani