পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

দেওরি সংস্কৃতি

দেওরি/চুতিয়া ভাষায় ‘জল’ শব্দের প্রতিরূপ হলো ‘দি’। মনে করা হয় এই ‘দি’ শব্দ থেকেই উজানি অসমের সমস্ত নদী যেমন, দিবাং, দিসাং, দিসিং, দিখৌ ইত্যাদি নদীর নামকরণ হয়েছে। এদের আদি বাসস্থান ছিল অবিভক্ত অসমের পূর্বপ্রান্তে। লোককথা অনুযায়ী, জোইদাম ও পাতকই পাহাড়ের পাদদেশ এবং উচ্চ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এরা বসতি স্থাপন করে। সেখান থেকে পরিযানের মাধ্যমে অরুণাচল প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্স অংশে মূলত চা শ্রমিক এবং কাঠ কাটার শ্রমিক হিসেবে এই জনজাতির মানুষ এসে বসতি গড়ে তোলে। বর্তমানে এই জনজাতির কেবলমাত্র দিবঙিয়া গোত্রটিই এই ভাষার বহুল ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া এই জনজাতির অন্য তিনটি গোত্র হলো পাতোরগোয়ান, বড়গোয়ান এবং টেংগাপোনিয়া। অন্য গোত্রগুলি সরকারি ভাষা অসমিয়ার ব্যবহারে অভ্যস্ত।

দেওরি জনজাতিকে অসমের প্রাচীন ব্রাহ্মণগোষ্ঠী বলে মনে করা হয়। এরা পূজার্চনা এবং অন্যান্য ধর্মীয় রীতিনীতির পালক হিসেবে পরিচিত। স্কুলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দেওরি জনজাতির শিশুরা দেওরি ভাষার ব্যবহারেই অভ্যস্ত হয়। এই জনজাতির মধ্যে আন্তর্বিবাহ প্রচলিত। যদি একজন দিবঙিয়া গোত্রের নারী অদিবঙিয়া সমাজের পুরুষকে বিবাহ করেন, তাহলে তাদের সন্তান প্রথম ভাষা হিসেবে দেওরির পরিবর্তে অসমিয়া ভাষাকেই গ্রহণ করে। শিশু কোন ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করবে- এই বিষয়টি সম্পুর্ণভাবে পিতামাতার ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল। দেওরি জনজাতিতে সম্পুর্ণভাবে দেওরিভাষী দম্পতির দেখা পাওয়া যায় না। নতুন প্রজন্ম বাড়িতে দেওরি ভাষায় কথাবার্তা বললেও পূর্ববর্তী প্রজন্মের মতো অবাধ স্বাচ্ছন্দে ভাষাটির ব্যবহার করতে অক্ষম। কিন্তু পূর্ববর্তী প্রজন্মের মধ্যে ভাষাটিকে পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরণের একটি সচেতন প্রচেষ্টা দেখা যায়। ফলে এই জনজাতির ভাষাটি বিপন্ন ভাষার তালিকায় থাকলেও এর অস্তিত্বের সংকট এখনো তৈরি হয়নি। ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি পালনের ক্ষেত্রে দেওরি ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিবাহ এবং জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানগুলিতে দেওরি জনজাতি এই ভাষায় রভিত মন্ত্রের ব্যবহার করে।

নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে এই জনজাতি মোঙ্গলয়েড শ্রেণিভুক্ত। এদের চারটি প্রধান গোত্র আবার কতকগুলি উপগোত্রে বিভক্ত। এই উপগোত্রগুলি হলো যথাক্রমে আরিয়া, কুমোতায়া, বিহিয়া, নারোদা, সুন্ধারিয়া, মাচিয়া, বিকোমিয়া, ফাপোরিয়া, কুলিয়া ইত্যাদি। এদের বসবাসের গৃহ ‘চাংঘর’ নামে পরিচিত, যা মূলত বাঁশ ও কাঠের তৈরি। বাড়ির প্রথম ঘ্রটিকে বলা হয় ‘সুবাসানি’ যা দেবতার আবাসস্থল হিসেবে নির্মিত হয়। এরা শুকর পালনে অভ্যস্ত।পশুগুলির জন্য বাড়ির নিচের তলায় পৃথক ঘর নির্মাণ করা হয়। বাড়ির উপরের তলার ঘরের মেঝেতে এরা ছিদ্র রাখে যাতে অতিরিক্ত শস্যকণা নিজে থেকেই উক্ত পালিত পশুগুলির কাছে পৌঁছে যেতে পারে। প্রত্যাকটি চাংঘরেই ফায়ারপ্লেস রাখা হয়য়, যাকে ‘দুদপাটি’ বলা হয়। এদের প্রধান উৎপাদিত ফসল ধান, ভুট্টা সুপারি ইত্যাদি। প্রধান খাদ্য ভাত, তবে বিভিন্নপ্রকার মাংস ও শাকসবজিও এরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

দেওরি জনজাতির প্রধান উপাস্য দেবতা হলেন ‘কুন্দিমামা’। এরা আন্তর্গোত্র বিবাহে অভ্যস্ত। একটি নির্দিষ্ট গ্রামে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোত্রের দেওরিরাই বসবাস করে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে বিবাহ দেওয়া স্বীকৃত এবং কোনো পুরুষ একবারই মাত্র বিবাহ করার অধিকারী। বিবাহের অনুষ্ঠান চার প্রকার হয়; ‘দামাচি’, ‘সাচি’, ‘চোরুবাসি’ ও ‘দালিবিহা’। বিবাহের দিন পাত্রপক্ষ কন্যার বাড়িতে পৌঁছলে ‘দেওদাই’ নামে এক বিশেষ ব্যক্তি ‘সুজেলংদুরাবা’ নামে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দৈব অনুগ্রহ প্রার্থনা করে। দেওরি পুরুষের সাধারণ পোষাক ‘ইখুন’ নামে পরিচিত। মহিলাদের পোষাক ‘উজাদুবা ইগুন’ নামে পরিচিত। এদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক ‘তেঘিরা’ নামে পরিচিত। দেওরিরা বছরে দুবার উৎসব পালন করে যেগুলি কৃষিকাজের সঙ্গে সংযুক্ত। এই দুটি উৎসব যথাক্রমে ‘বোহাগ বিহু’ ও ‘মাঘ বিহু’ নামে পরিচিত। ‘বোহাগ বিহু’ হলো এদের প্রধান পালিত উৎসব যা সাতদিন ধরে পালিত হয়। এই উৎসবে পুরুষ ও মহিলা উভয়ে মিলে ‘বিসু নাচ’ নামে এক বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠান করে। এই সময় ‘দুরুম’, ‘কোকিলি’, ‘টোকামারি’, ‘তাল’ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে দেওরি জনজাতির ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের অবনমন ঘটলেও পূর্ববর্তী প্রজন্মের সচেতনতার কারণে এই ভাষা ও সংস্কৃতি এখনো সম্পুর্ণ বিলুপ্তির পর্যায়ে পড়েনি।

গ্রন্থপঞ্জী:

Acharya, P. & Mahanta, S. 2019 Language Vitality Assessment of Deori: An Endangered Language; Language Documentation & Conservation

Census of India-2011

Nath, A. K. 2012 Sound Change in Deori: A Descriptive Account; Journal of Universal Language.

Phukan, M. 2019 The Deori Tribe of Assam: A socio-cultural study; International Journal of Applied Research