‘মারিং’ শব্দটি ‘মেই’ অর্থাৎ আগুন এবং ‘রিং’ অর্থাৎ ‘উৎপন্ন করা’ এর সংমিশ্রণে গঠিত। মারিং জনজাতির মানুষদের ‘মারিংগা’ বলা হয়। প্রাচীন লোককথা অনুসারে এরা একসময় ‘নুংমুইশো’ নামে এক গুহায় খোপু-রাম্পুইত নামে একজনের অধীনে বসবাস করতো। এদের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রধান দেবতা হলেন ‘ওম’-তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ ‘সিম্পি-সাপিপু’। এছাড়া মারিং জনজাতির অন্যান্য উপাস্য দেবতারা হলেন ‘থ্রাই’, ‘রাম্পু টুপু’ (পবিত্র/উচ্চ স্থানের দেবতা), গ্রামদেবতা অর্থাৎ ‘খোলামাল-পু’ এবং পূর্বপুরুষ অর্থাৎ ‘চিম থ্রাই’। দেবতার উপাসনাকালে মারিং জনজাতি সবসময় দেবতার উদ্দেশ্যে জিনিসপত্র নিবেদন অর্থাৎ ‘থুইনা-পুট-মাকাত’ করে, যেমন পশু অর্থাৎ ‘মালামথুত’ পাখি এবং ‘মিথুন’ নামে এক বিশেষ পশু নিবেদিত হয়। এদের উর্বরতার দেবতা হলেন উমহাই, পৃথিবীর দেবতা হলেন সিমলেই-থাংওয়ান পু। এছাড়া মারিং জনজাতি অপদেবতা ও দুষ্ট আত্মা অর্থাৎ ‘সেয়া ক্রাও’, ‘লাঙ্গা’, ‘তাঠি ক্রাও’, ‘কেমাং ক্রাও’ ইত্যাদির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, যারা মূলত মানুষের রোগ, অসুস্থতা এবং দুর্দশা সৃষ্টি করে। এই অপদেবতাদের পূজা করা হয় না, কিন্তু ‘লুক খাং’, ‘লুক থুট’ ইত্যাদি পশু বলির মাধ্যমে এদের সন্তুষ্ট রাখা হয়। এরা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করে। এরা বিশ্বাস করে যে, যারা ভালো কাজ করে তারা উপরে অর্থাৎ স্বর্গ এবং যারা খারাপ কাজ করে তারা পৃথিবীর ভিতরে একটি জায়গা (খাইয়া রাম অর্থাৎ নরক) এ স্থান পায়। ভালো কাজের পুরষ্কার স্বরূপ মানুষ পৃথিবীতে পুণর্জন্ম লাভ করে।
মারিং জনজাতিতে সাতটি গোত্রের অস্তিত্ব আছে। এই সাতটি গোত্র হলো- চারাঙ্গা, খুলপুওয়া, মাকুংগা, দাংসাওয়া, কানসোউয়া, তাংতাংগা এবং খেলয়া। মারিং জনজাতি প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানেই কিছু বিশেষ রীতির পালন করে থাকে। বীজ বোনা, ফসল কাটা, বাড়ি তৈরি ও গৃহপ্রবেশ, শিশুর জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুর পর অন্তেষ্টির অনুষ্ঠান পালিত হয়। এদের প্রধান পালিত উৎসব হলো ‘হুনুংকাপ’, যা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পালিত হয়। উপকথা অনুসারে মারিংরা ছিল মূলত শিকারি জাতি, যারা সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করতো। গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পর একটি অপ্রাকৃত পশুর আক্রমণের শিকার হয়ে বহু মানুষ নিহত হয়। তখন মারিং জনজাতির গ্রাম সংগঠন লেইপাক –উপা, খুলপু-খুল্লাক ও কেইসাং এর দ্বারা ঐ পশুটিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তারা ঐ বিশালাকার পশুটিকে হত্যা করতে সমর্থ হয়, যাকে তারা ‘সোভিয়া’ নামে অভিহিত করতো। এই হত্যা মারিং সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিটি মারিং গ্রামেই এই উৎসব পালিত হয়। পাঁচ বছর ছাড়া আগত এই উৎসবের বছরটি ‘হুংকুম’ নামে পরিচিত। এই উৎসব মে মাসে পালন করা হয়। ঐ পশুটির একটি মূর্তি তৈরি করে গ্রামের মধ্য বা পশ্চিমে অবস্থিত একটি গাছ থেকে ঝোলানো হয়। এই টোটেমটি তৈরি করতে ‘কান্ত্রো’ নামক গাছ ব্যবহার করা হয়। গ্রাম সংগঠনের অন্তর্গত ‘সোউপুলরুই’ পদে থাকা ব্যাক্তি টোটেমটিকে সাজানোর দায়িত্বে থাকেন। গাছে ঝোলানো অবস্থায় তীর ছুড়ে মূর্তিটিকে ধ্বংস করা হয়।
মেয়েদের নামকরণের ক্ষেত্রে মারিং জনজাতি একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রথম কন্যার পদবীতে ‘আতে’, দ্বিতীয় কন্যার ক্ষেত্রে ‘আতো’, তৃতীয়ের ক্ষেত্রে ‘আপো’, চতুর্থের ক্ষেত্রে ‘আখু’, পঞ্চম ও পরবর্তীদের ক্ষেত্রে ‘আখাম/লেইবি’ যুক্ত হয়। পুত্রের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ‘আমো’, ‘আকো’, আঙ্গা’, ‘আমে’ ও ‘লেইবা’ ব্যবহার করা হয়। পুরুষ ও নারী উভয়েই লম্বা চুল রাখে। এক্ষেত্রে পার্থক্যটি হলো- পুরুষরা ‘মুজেম’ নামে শিং এর মতো একপ্রকার ঝুঁটি সামনের দিকে বাঁধে, মহিলারা ‘সাম্ফান’ নামে ঝুঁটি পিছনের দিকে বাঁধে। মহিলাদের পোষাক ‘ইয়ারুইলাক ফিখাম’ এবং পুরুষদের পোষাক ‘ফি লাংফাই’ নামে পরিচিত। উভয় পোষাকের রঙই সাদা, এবং তা সাধারণ। মহিলারা তাদের মাথায় একটি রঙীন কাপড় রাখে, যা ‘ধোতি’ নামে পরিচিত।
মারিং সমাজে দুই ধরণের বিবাহের প্রচলন রয়েছে। ‘লু-হং’ অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ এবং ‘ত্রুক’ অর্থাৎ অপহরণের মাধ্যমে বিবাহ। ‘লু-হং’ এর ক্ষেত্রে প্রথমে কন্যার পিতার কাছে বিবাহের সম্মতি গ্রহণ অর্থাৎ ‘তুল-সর’ হয়। তারপর ‘লাম্পু-খাম’ অর্থাৎ বিবাহের দিন স্থির করা হয়। কন্যা ও পাত্র উভয়ের বাড়িতেই বিবাহের অনুষ্ঠান হয়। পাত্রের বাড়ি থেকে বিবাহের সমস্ত খরচ বহন করা হয়। ‘ত্রুক’ এর ক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠান হয় না। পুত্র ও কন্যার পরিবারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে কর্তব্য স্থির করা হয়। পুত্রের বাড়ি থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কন্যার বাড়িতে মদ ও শুকর পাঠানো হয়।
বর্তমানে মারিং সমাজের অধিকাংশ মানুষ খ্রিস্টধর্মে পরিবর্তিত হওয়ার ফলে এই প্রাচীন প্রথা, সংস্কৃতি ও ভাষা বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ইংরেজি ভাষায় আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ফলে মারিং ভাষা-সংস্কৃতি পিছিয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এগুলির সংরক্ষণে যথাযথ আগ্রহের অভাব রয়েছে।
Census of India, 2011
Census of India, 2001
Kumar, B.B. 2005 Naga Identity. New Delhi
Hudson, T.C. 2007 The Naga Tribes of Manipur. New Delhi