তামাং ভাষা
ভারতের সিকিম রাজ্য, পশিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা এবং বহির্ভারতে নেপালে তামাং জনজাতির মানুষের বসবাস। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে ভারতে বসবাসকারী তামাং জনজাতির মানুষের সংখ্যা ১৫৩৯৮৩০ জন। দার্জিলিং জেলার স্বশাসিত গোর্খা পার্বত্য পরিষদ (Darjeeling Gorkha Autonomous Hill Council-DGAHC) বসবাসকারী জনজাতিগুলির মধ্যে তামাংরা সখ্যায় সর্বাধিক-১২৫৯৮৭ জন। তামাং জনজাতির মানুষ নিসাং, সাং, সাই, মূর্মি ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
তিব্বতি লোককথা অনুসারে তামাং জনজাতি তিব্বতের একটি জনগোষ্ঠী, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে তিব্বতি সম্রাট খ্রিস্ট্রং দুতস্যেন এর সময়কালে বৌদ্ধ নিদর্শন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মগধে অভিযান করেন। ফিরতি পথে এদের একটি অংশ তিব্বত-নেপাল সীমান্তে বসতি গড়ে তোলে-এরাই তামাং জনজাতির পূর্বপুরুষ। লামা (২০১০) এর মতে, তিব্বতি শব্দ ‘তামাগ’ (Tamag) থেকে তামাং শব্দের উৎপত্তি; যার প্রকৃত অর্থ ‘ঘোড়সওয়ার সৈন্য’ (mounted army)। কর্নেল সন্তবীর লামা তাঁর ‘তাম্বা কাইতেন’ (Tamba Kaiten) নামক বইতে উল্লেখ করেছেন যে, তামাঙ, ইয়োলমো এবং শেরপাদের প্রাচীন বাসভূমি ছিল নেপাল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে নেপাল যখন তিব্বতি শাসনাধীনে আসে, তখন এরা তিব্বতি লিপি গ্রহণ করে। মুণ্ডুং (Mundung) নামক তামাং জনজাতির প্রাচীন লোকগানেও এদের তিব্বত থেকে পরিযানের কোন উল্লেখ নেই।
আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তামাং জনজাতির সঙ্গে কিরাতদের দেহগাঠনিক সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। তামাঙদের মুখ ও দেহের গঠনে মোঙ্গলয়েড ছাপ স্পষ্ট- ভারী দেহ, মাঝারি-খর্ব উচ্চতা, ক্ষুদ্র, বাদামসদৃশ চোখ, কৃষ্ণকায়। মুখমণ্ডলে রোমের আধিক্য নেই, কণ্ঠার হাড় উঁচু, চ্যাপ্টা নাক, চওড়া মুখ, চোয়াল গোলাকার।
গ্রিয়ারসনের মতে (১৯০৯, ১৯৬৭; ১৮৯), গুরুং ভাষার মতোই মূর্মি (তামাং) ভাষাও তিব্বতি ভাষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। নুনান (২০১১) তামাং, গুরুং, থাকলি, মংপা, নারফু, তাংবে ইত্যাদি ভাষাকে তামাঙ্গিক (Tamangik) শ্রেণিভুক্ত করেছেন, যেটি তিব্বত-বর্মীয় ভাষা পরিবারের তিব্বতি শাখার একটি উপশাখা। তামাং ভাষার দুটি উপভাষা বর্তমান-পশিমা তামাং ও পূর্বী তামাং, এই দুটি উপভাষার মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতা অনুপস্থিত। এই ভাষার নিজস্ব লিপি না থাকায় এই জনজাতির ভাষায় লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্ব খুব কম, এরা তিব্বতি ও দেবনাগরী লিপি ব্যবহার করে; তবে তামাং জনজাতির মৌখিক ও লৌকিক উপকথা, গান ইত্যদির সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে যেখানে এই জনজাতির সমাজ, অর্থনীতি ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তামাং ভাষা অন্যান্য তিব্বত-বর্মীয় ভাষার মতোই ধ্বনিপ্রধান (tonal) – স্বল্প থেকে মাঝারি (মাজাউদন, ১৯৭৮)। এই ভাষায় ব্যঞ্জনধ্বনি শব্দের প্রথমে বা শেষে বসতে পারে। উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী ৬টি এবং উচ্চারণের পদ্ধতি অনুযায়ী ১১টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে। তামাং ভাষায় উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন, এবং সম্মুখ, কেন্দ্রস্থ ও পশ্চাৎ- স্থানের প্রকারভেদ অনুসারে ৫টি স্বরধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। তামাং ভাষায় সংখ্যাবাচক শব্দ বিশেষ্যের পরে বসে। বহুবচনের চিহ্ণক হলো- কাদে/গাদে (-kade/-gade) এবং –ধুগু/-জুগু (-dhugu/-jugu)। তামাং ভাষার শব্দগুলি দুটি অথবা তিনটি রেজিস্টার (register) এ বিভক্ত, অর্থাৎ পরিস্থিতি ও ব্যক্তিমানুষের বয়স, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়। বক্তা যদি কোন শিশু বা নিম্ন মর্যাদার ব্যক্তির সাথে কথা বলেন, তাহলে নিম্ন অথবা আটপৌরে (low/ informal) রেজিস্টার ব্যবহার করেন; সমমর্যাদা ও সম্মানীয় ব্যক্তির সঙ্গে বাক্যালাপের সময় তুলনামূলক আনুষ্ঠানিক(formal) রেজিস্টার ব্যবহার করেন। তামাং জনজাতির তাম্বা সম্প্রদায় ‘তাম্যিক লিপি’ (Tamyik script) ব্যবহার করে তামাং ভাষার নিজস্ব বই রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তাম্যিক লিপি ‘নিখিল ভারত তামাং বৌদ্ধ পরিষদ’ (All India Tamang Buddhist Association-AITBA), ‘দার্জিলিং নেপাল তামাং গেদাং’, ‘সিকিম তামাং বৌদ্ধ পরিষদ’ ইত্যাদি সংগঠনের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে দার্জিলিং থেকে প্রকাশিত বুধিমান মোক্তাং রচিত ‘জিক্তেন তামছোয়ে’ (Jikten Tamchhoyee/ Tamang Vanshavali) হলো তামাং ভাষার প্রথম মুদ্রিত বই। তামাং ভাষা ‘তামাং টাম’ (Tamang Tam), ‘তামাং লেঙমো’ (Tamang Lengmo), ‘তামাং গৎ’ (Tamang Gyot) প্রভৃতি নামে পরিচিত।
গ্রন্থপঞ্জী :
Tamang, Anjana. THE TAMANG COMMUNITY IN SIKKIM: A HISTORICAL STUDY. School of Social Sciences, Sikkim University, 2016.
Tamang, Shradhanjali, INDIGENOUS ORAL HISTORY TRADITION IN DARJEELING AND SIKKIM HIMALAYAS. Salesian Journal of Humanities and Social Science, 2018
Dasgupta, Sayantan & Tamang, Shradhanjali. Tamang Selo: An Anthology, Annotated Text and English TRanslation, Vol 2. Jadavpur University Press, 2015.
Lama, ST. “Ethnographic Notes on Tamang”, Phyallow-Vol 2, All India Tamang Buddhist Association, Official Record (Unpublished), 1981-2000.