সাঁওতালি ভাষা

অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্গত মুন্ডা ভাষা পরিবারের একটি ভাষা হল সাঁওতালি। বাংলাদেশ, নেপাল, এবং ভারতের আসাম, বিহার, ঝাড়খন্ড, মিজোরাম, ওড়িশা, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে প্রধানত কথ্য এই ভাষা। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ভারতে মোট ৭,৩৬৮,১৯২ জন সাঁওতালি ভাষাভাষী রয়েছে । রাজ্যভিত্তিক বন্টন হল ঝাড়খন্ড (২.৭৫ মিলিয়ন), পশ্চিমবঙ্গ (২.৪৩ মিলিয়ন), ওডিশা (০.৮৬ মিলিয়ন), বিহার (০.৪৬ মিলিয়ন), আসাম (০.২১ মিলিয়ন) এবং ছত্তিশগড়, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং ত্রিপুরার প্রতিটিতে কয়েক হাজার। এছাড়াও, সাঁওতালি ভাষা ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিল অনুসারে ভারতের একটি স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষা। আদমশুমারির তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, সাঁওতাল জনসংখ্যার ঘনত্বের সবচেয়ে কমপ্যাক্ট এলাকা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম অংশ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও আসাম। এই ভাষার কিছু ভ্যারাইটি অর্থাৎ প্রকার হল মাহালি, পাহাড়িয়া, মাঝি-ভাষা।

সাঁওতালি ভাষার নামটি উঠে এসেছে সাঁওতাল জাতির নাম থেকেই- সাঁওতালদের ভাষার নাম সাঁওতালি। সাঁওতালরা নিজেরা তাদের ভাষাকে বলে থাকে হর (hɔɽ) বা হর রর (hɔɽ rɔɽ)। আরও খুঁটিয়ে দেখলে, হর (hɔɽ), যার মানে ‘সাঁওতাল মানুষ’ এর সাথে রর (rɔɽ) অর্থাৎ 'ভাষা/ স্পীচ' কে সংযুক্ত করে, পায় 'সাঁওতালদের ভাষা'। জাতিগত ভাবে ভারতের প্রাচীনতম গোষ্ঠী হওয়াতে এদেরকে আদিবাসী (‘যারা এই ভূমিতে আদিকাল থেকে বসবাস করছে’) বলা হয়ে। ১৯২৫ সালে পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু কর্তৃক অল চিকি লিপির বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত সাঁওতালি একটি প্রধানত মৌখিক ভাষা ছিল। ওল চিকি হল বর্ণানুক্রমিক (অ্যালফাবেটিক), অন্যান্য ভারতীয় লিপিগুলির মতো সিলেবিক নয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডে ওল চিকি হল সাঁওতালি সাহিত্য ও ভাষার সরকারি লিপি। তবে বাংলাদেশে বাংলা লিপি ব্যবহার করা হয়।

সাঁওতালিতে ২১টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে, ৮টি মৌখিক এবং ৬টি অনুনাসিক স্বরধ্বনি রয়েছে। এই ২১টি ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে প্লোসিভ আছে ৫টি বিভগের- লেবিয়েল, অ্যালভিওলার, পোস্ট-অ্যালভিওলার, প্যালাটাল এবং ভিলার, এবং এই ৫টি বিভাগেরই নেসাল অর্থাৎ অনুনাসিক ব্যঞ্জনধ্বনি। এছাড়াও আছে একটা ট্রিল, একটা ফ্ল্যাপ, একটা ল্যাটারাল, দুটো ফ্রিকেটিভ আর দুটো অর্ধস্বর বা সেমি-ভাওয়েল। আটটি স্বরবর্ণের দৈর্ঘ্যের কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। ভাষাটিতে ডিপথং এর রাইসিং এবং ফলিং প্রকার দুটোই আছে। সাঁওতালি ভাষার শব্দগুলো বেশিরভাগই ডাইসিলাবিক হয়, এবং ডাইসিলাবিক আর মাল্টিসিলাবিক শব্দগুলির দ্বিতীয় শব্দাংশে (দ্বিতীয় সিলাবেলে) স্ট্রেস থাকে। মনোসিলেবিক শব্দ হলে রুট ভাওয়েল স্ট্রেস বহন করে। ভাষাটিতে সিলাবেল প্রধানত CV কাঠামোর হয়, কিন্তু CVC কাঠামোও লক্ষ্য করা যায়। ভাষার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল যে সিলাবেলের নিউক্লিয়াস গঠন করতে পারে অনুনাসিক ব্যঞ্জনধ্বনি, এটি মুন্ডা ছাড়া ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে আর কোথাও দেখা যায় না।

সাঁওতালি একটি সাফিক্সিং-ওয়ালা অ্যাগ্লুটিনেটিভ ভাষা, অর্থাৎ এই ভাষায় শব্দ তৈরি হয় ক্ষুদ্র মর্ফিম যুক্ত করে এবং প্রত্যেকটি মর্ফিম সাধারণত একটিই মানে বহন করে বা একটিই ফাংশন থাকে। ব্যাকরণগতভাবে, সাঁওতালি ভাষায় বিশেষ্য, সর্বনাম, ক্রিয়াপদ, বিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ, ডেমোনস্ট্রেটিভ, আর পার্টিকল আছে। বিশেষ্যের আর ডেমনস্ট্রেটিভের দুই প্রকার রুপভেদ দেখা যায়, সজীব (অ্যানিমেট) এবং জড় (ইন্যানিমেট)। কয়েকটি বিশেষ্যপদের ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ পার্থক্য প্রতীয়মান থাকে। এছাড়াও বিশেষ্যের ক্ষেত্রে বচনেরও পার্থক্য দেখা যায়- একবচন, দ্বিবচন এবং বহুবচন। ডেমনস্ট্রেটিভের আরও তিন প্রকার রুপভেদ দেখা যায়- সরল, প্রশ্নবাচক এবং ইন্ডেফিনিট। ক্রিয়াপদের তিন প্রকার রুপভেদ দেখা যায়, যা হলো কাল, ভাব, ও প্রকার। সমাপিকা ক্রিয়াপদে /আ/ মার্কারটি সম্পূর্ণতা বোঝায়। বাংলা ভাষার মতোই সাঁওতালি ভাষারও বাক্যের SOV গঠন (কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া)।

গ্রন্থপঞ্জী :

Census of India- 2011

https://doi.org/10.4324/9781315822433

Mishra, Shibendhushekhar (2017). Saotal Samaj Sanskriti o Sangram. Lok Sanskriti o Adivasi Sanskriti Kendra