বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষা
বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের ভারতীয়-আর্য শাখার পূর্বী উপশাখার একটি ভাষা। মূলত ভারতের মণিপুর,অসম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের বসবাস রয়েছে। এছাড়া ভারতের বাইরে বাংলাদেশের কিছু জেলা, যেমন- শ্রীহট্ট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ভাষার ব্যবহার রয়েছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুযায়ী বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ১২০০০০। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই; লেখার কাজে মূলত বাংলা ও অসমিয়া লিপি ব্যবহার করা হয়।
প্রধানত মণিপুর রাজ্যের লোকটাক হ্রদের তীরবর্তী অংশে এই জনজাতির মানুষের আদি বাসভূমি। ডালটন ও গ্রিয়ারসনের প্রামাণ্য গ্রন্থগুলিতে এই ভাষার পৃথক অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছে। গ্রিয়ারসনের মতে, উনিশ শতকের আগে থেকেই মণিপুরে এই ভাষার প্রচলন ছিলো। তিনিই সর্বপ্রথম এই ভাষাকে বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি নামে অভিহিত করেন। পরবর্তীকালে মেইতেই ভাষার অধিক জনপ্রিয়তার কারণে এই ভাষাটি ক্রমশ পিছনের সারিতে চলে যায়। অসমের কাছাড় জেলা এবং বাংলাদেশেও বাঙালি জনাধিক্যের কারণে বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এই ভাষাটি ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে।
বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষা এই জনজাতির মানুষের কাছে ‘ইমার-ঠার’ নামে পরিচিত; এই কথাটির আভিধানিক অর্থ হল ‘আমার মায়ের ভাষা’। এই ভাষার উপর সংস্কৃত, মহারাষ্ট্রী ও শৌরসেনী- প্রাকৃতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। কে পি সিংহের মতে, এই ভাষার উৎপত্তি মাগধী-প্রাকৃত থেকে। তাঁর মতে, বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষায় মাগধী-প্রাকৃতের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভাষার সর্বনাম এবং কনজুগেশনাল এন্ডিংগুলি লক্ষ্য করলে মৈথিলি, ওড়িয়া এবং বাংলার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এই ফর্মগুলি মাগধী অপভ্রংশ অবহট্ট থেকে বাংলা ও ওড়িয়া ভাষার মাধ্যমে আলোচ্য ভাষায় স্থান পেয়েছে। এই সমস্ত বিষয়গুলি মাথায় রাখলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, যদিও ভাষাটি মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচলিত; তবুও এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত, এই ভাষার কোনো তিব্বত-বর্মীয় যোগসূত্র নেই। এই বিষয়টি অনস্বীকার্য হলেও, মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত মেইতেই ভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষার ব্যাকরণ ও ধ্বনিতাত্ত্বিক দিকগুলিকে প্রভাবিত করেছে। এই ভাষার বিকাশের বিভিন্ন স্তরে মাগধী, শৌরসেনী, অবহট্ট, মেইতেই প্রভৃতি ভাষাগুলির প্রভাব যথেষ্ট। বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষা মেইতেই ভাষার পুরনো ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে অনেকাংশে গ্রহণ করেছে।
এই ভাষার মূলত দুটি প্রকার রয়েছে- ‘রাজার গাঙ’ ও ‘মাদাই গাঙ’। মণিপুর রাজ্যের দুটি নির্দিষ্ট এলাকায় এই প্রকার দুটির ব্যবহার রয়েছে। ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকে ‘মাদাই-গাং’ প্রকারটির সঙ্গে অসমিয়া ও মেইতেই ভাষার অধিকতর সাদৃশ্য রয়েছে; অপরপক্ষে, ‘রাজার গাঙ’ প্রকারের সাথে বাংলা ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক সাদৃশ্য রয়েছে। এই দুই প্রকারের মধ্যে তেমন কোনো শব্দতাত্ত্বিক বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ে না। অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ভাষার মতো বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষার শব্দভাণ্ডারে তদ্ভব শব্দের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এই শব্দগুলি মূলত সংস্কৃত ভাষা থেকে এই ভাষার শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছে। এদের মধ্যে ব্যাকরণ এবং উচ্চারণের নিরিখে বেশ কিছু ঐতিহাসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া এই ভাষায় অনেক তৎসম শব্দও প্রবেশ করেছে; যেগুলি সংস্কৃত ভাষা থেকে কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষাগুলির শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করে। এছাড়া মেইতেই, ইংরেজি এবং পারস্য- আরবিকভাষাগুলি থেকেও কিছু শব্দ এই ভাষার শব্দভাণ্ডারে স্থান করে নিয়েছে।
বিষ্ণূপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষা পূর্বতন মেইতেই ভাষার ১৮টি ধ্বনি গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে ৩টি স্বরধ্বনি, ১৩টি ব্যঞ্জনধ্বনি এবং ২টি অর্ধ-স্বরধ্বনি রয়েছে। পরবর্তীকালে মেইতেই ভাষাতে আরও ৯টি ধ্বনি যুক্ত হলেও বিষ্ণুপ্রিয়া- মণিপুরিতে এই নতুন ৯টি ধ্বনির কোনো অস্তিত্ব নেই। এর কারণ হিসেবে বলা যায় যে, উনিশ শতকের পর থেকেই এই জনজাতি বিভিন্ন কারণে মণিপুর থেকে পরিযানের মাধ্যমে বৃহত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক এই কারণেই মেইতেই ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলি বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরিতে সেভাবে চোখে পড়ে না। এই ভাষাতে মেইতেই এর প্রভাবের বিষয়টি একটি উদাহরণে স্পষ্ট হবে। মেইতেই ভাষার অনুসরণে এই ভাষাতে শব্দের শুরুতে ‘ঙ' ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বিষ্ণুপ্রিয়া- মণিপুরিকে বাংলা ভাষার একটি পৃথক প্রকার হিসেবে গণ্য করেছিলেন। অপরদিকে, মহেশ্বর নেওগ এবং বাসন্তী কাকতির মতে, এই ভাষা অসমিয়া ভাষার একটি প্রকার। কিন্তু পরবর্তীকালে এই দুটি পৃথক মতই ভ্রান্ত বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি জনজাতি দেবনাগরী লিপিকেই তাদের নিজস্ব লিপি হিসেবে গণ্য করতো। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসনকালে তারা বাংলা ও অসমিয়া লিপির ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
এই ভাষার সাহিত্যিক নিদর্শনগুলি মূলত মৌখিক। এদের লিখিত সাহিত্যের নিদর্শন তেমনভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে লোককথা, রূপকথা, মৌখিক কবিতা ইত্যাদির অস্তিত্ব রয়েছে। এই ভাষার গানগুলিতে মূলত পূর্বতন মেইতেই ভাষার শব্দের আধিক্য থাকলেও বর্তমানে এই সমস্ত গানে তিব্বত-বর্মীয় শব্দভাণ্ডার থেকে ক্রমশ অনেক শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটছে। এছাড়া এই ভাষায় মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু গান রয়েছে, যেগুলি মূলত মাঠে কাজ করার সময় গাওয়া হয়। এছাড়া এই ভাষায় প্রবাদ-প্রবচনেরও অস্তিত্ব রয়েছে। সাহিত্যের বিকাশ এবং উন্নতির লক্ষ্যে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এই জনজাতি নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ গঠন করেছে। এই ভাষায় সাহিত্যচর্চা মূলত বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে শুরু হয়। বস্তুতপক্ষে, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ ফাল্গুনী সিংহ সম্পাদিত "জাগরণ" পত্রিকার মাধ্যমেই মণিপুরি সাহিত্যের বিকাশ আরম্ভ হয়।
গ্রন্থপঞ্জী :
Census of India- 2001
Grierson, G.K. 1903. Linguistic Survey of India; Vol-5
Singha, Dr. K.P. 1982. An Etymological Dictionary of Bishnupriya Manipuri
Singha, J.M. & Singha, B. 1976. The Bishnupriya Manipuris and their language; Silchar