বোড়ো ভাষা

বোড়ো ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষবংশের ব্রহ্মপুত্র শাখার বোড়ো-গারো উপশাখার একটি ভাষা; যা মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম রাজ্যের বোড়োল্যান্ড, পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা এবং নেপালের কিছু অংশে প্রচলিত। বর্তমানে এই ভাষাটি অসমের বোড়োল্যান্ড নামক স্বশাসিত অংশের সরকারি ভাষা এবং সমগ্র অসমের একটি সহযোগী সরকারি ভাষা, যা ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিলেও স্থান করে নিয়েছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে বোড়ো জনজাতির মোট জনসংখ্যা ১৪ লক্ষ হলেও এদের ভাষাটি ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় ‘ভালনারেবল’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে। ‘দেওধাই’ নামে বোড়ো ভাষার নিজস্ব লিপির প্রচলন পূর্বে থাকলেও ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে লেখার কাজে বাংলা, অসমিয়া ও ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করা হয়।

বোড়ো সংগঠনগুলির সমাজ-রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম অসমের বোড়ো জনজাতি অধ্যুষিত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে বোড়ো ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে অসম রাজ্যের বোড়ো অধ্যুষিত এলাকায় মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বোড়ো ভাষা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বোড়ো ভাষায় স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগ রয়েছে। অসমের কোকরাঝাড় এলাকায় ব্যবহৃত বোড়ো ভাষার রূপভেদটিকে মান্যরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়। পূর্বে বোড়ো এবং ডিমাসা উভয় ভাষাতেই ‘দেওধাই’ নামক লিপি ব্যবহৃত হলেও ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করে বোড়ো ভাষার একটি প্রার্থনা সঙ্গীতের বই রচিত হয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম বোড়ো ভাষায় বাংলা ও অসমীয়া লিপির ব্যবহার শুরু হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘বিবার’ নামে একটি ত্রিভাষিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো, যা ছিল একাধারে বাংলা, অসমীয়া ও বোড়ো ভাষায় লিখিত। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ‘বোড়ো সাহিত্য সভা’ বোড়ো ভাষার জন্য কেবলমাত্র অসমিয়া লিপি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বোড়ো জনজাতির খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অংশ এখনো ল্যাটিন লিপিই লেখার কাজে ব্যবহার করে।

বোড়ো ভাষার সঙ্গে রাভা, গারো, ডিমাসা, ককবরক, তিওয়া, হাজং ইত্যাদি উত্তর-পূর্ব ভারতের ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। বোড়ো ভাষাতে মোট ৩০টি ফোনিম রয়েছে; যার মধ্যে ৬টি স্বরধ্বনি, ১৬টি ব্যঞ্জনধ্বনি এবং ৮টি ডিপথং। এই ভাষায় ‘হাই-ব্যাক-আনরাউন্ডেড’ স্বরধ্বনির প্রাবল্য রয়েছে। দুটি শব্দের মধ্যে পার্থক্যের সূচক হিসেবে বোড়ো ভাষায় টোনের ব্যবহার আছে। ‘হাই’, ‘মিডিয়াম’ ও ‘লো’- এই তিন প্রকার টোন বোড়ো ভাষায় ব্যবহৃত হয়। ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি ন্যাসাল, প্লোসিভ, ফ্রিকেটিভ, ফ্ল্যাপ/ট্রিল এবং অ্যাপ্রক্সিমেন্ট প্রকৃতির হয়। ‘ফ’, ‘থ’, খ’ ইত্যাদি ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি কক্ষনো কখনো যথাক্রমে ‘ব’, ‘দ’ ও ‘গ’ রূপে উচ্চারিত হয়। বোড়ো ভাষার নিজস্ব শব্দের ক্ষেত্রে ‘ফ’, ‘থ’, খ’ ইত্যাদি ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি কখনোই শব্দের শেষে বসতে পারে না। কিন্তু লোন-ওয়ার্ড অর্থাৎ অন্য ভাষা থেকে আগত শব্দের ক্ষেত্রে এই বাধা নেই। এই ভাষায় কনসোনেন্ট-ক্লাস্টার কেবলমাত্র শব্দের শুরুতে অথবা মাঝে বসতে পারে। ভাষাটিতে ‘ক্লোজ’ অর্থাৎ বদ্ধ এবং ওপেন অর্থাৎ মুক্ত- এই দুই প্রকার জাঙ্কচারের ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া এখানে তিন প্রকার ইন্টোনেশন প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়- হাই-ফলিং, লো-রাইজিং ও লেভেল। উচ্চারণের পদ্ধতি অনুসারে বোড়ো ভাষার প্রতিটি স্বরধ্বনি ও ব্যাঞ্জনধ্বনির দুটি করে অ্যালোফোনের অস্তিত্ব রয়েছে। বোড়ো ভাষার সাধারণ বাক্যগঠন প্রণালী SOV অর্থাৎ কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া হলেও ক্ষেত্রবিশেষে কর্ম উহ্য থাকে। বোড়ো ভাষাতে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত শব্দের জন্য মৌলিক শব্দ রয়েছে; ১১ থেকে যৌগিক শব্দের ব্যবহার আরম্ভ হয়। বোড়ো ভাষার শব্দগুলির বেশিরভাগই মনোসিলেবিক; এদের মধ্যে অ্যাগ্লুটিনেটিভ ধর্মও দেখা যায়। এই ভাষার বিশেষ্য তিন প্রকারের হয়- বেসিক, ডিরাইভড ও কম্পাউন্ড অর্থাৎ যৌগিক প্রকৃতির। যৌগিক প্রকৃতির বিশেষ্যগুলি বিশেষ্য ও ক্রিয়া এবং দুটি বিশেষ্যের সমন্বয়েও গঠিত হতে পারে। বোড়ো ভাষার লিঙ্গবিভেদ ব্যাকরণগত নয়, এটি প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত হয়। পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ- এই দুইটি লিঙ্গের ব্যবহার এই ভাষায় নির্দিষ্ট। ক্রিয়ার তিনটি কাল বোড়ো ভাষায় প্রচলিত হলেও বর্তমান কালের ক্ষেত্রে ক্রিয়ার কোনো মার্কিং থাকে না। এই ভাষায় প্রধানত ‘পাস্ট-নন পাস্ট’ প্রভেদ দেখা যায়। অ্যাবলেটিভ ও জেনিটিভ সহ সাত প্রকার কেস বোড়ো ভাষায় প্রচলিত।

গ্রন্থপঞ্জী :

Brahma, P. 2014; Phonology and Morphology of Bodo and Dimasa: A Comparative Study (PhD)

Census of India- 2011

Das, K; Mahanta, S. 2019 Intonational Phonology of Bodo; Glossa: A Journal of General Linguistics.

Kachary, G.B. 2017; Material Culture of the Bodos: a descriptive analysis (PhD). Guahati University

Sharma, Dr. S. K. et al. A Wordnet for Bodo Language: Structure and Development