পাইতে জনজাতির মানুষ স্বভাবত লাজুক, মিতভাষী এবং পেশার প্রতি দায়বদ্ধ। ‘পাইতে’ শব্দটি ‘পাই’ অর্থাৎ ‘হাঁটা’ এবং বহুবাচনিক ‘তে’ শব্দের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। সমগ্রভাবে ‘পাইতে’ শব্দের অর্থ হলো একগুচ্ছ লোক যারা হাঁটছে। এদের যাযাবর প্রকৃতিই এদের এই নামের কারণ। তাদের মূল জীবিকা কৃষিকাজ হলেও বর্তমানে অন্যান্য পেশা এবং সংসদেও পাইতে জনজাতির মানুষ প্রতিনিধিত্ব করেন। এদের কৃষিকাজ মূলত পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ ও ঝুমচাষ। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত স্থানান্তরের সুবিধার জন্য এই জনজাতি স্থায়ী কৃষিকাজে আগ্রহী নয়। পাইতে জনজাতি ভারতের জনজাতিগুলির মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষভাবে এগিয়ে থাকা জনজাতি। এরা নিজেদের ‘জোমি’ বলে অভিহিত করে। তাদের প্রধান দেবতা হলেন ‘পাইথান’, এদের নিজস্ব ধর্মের অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে মণিপুর ও মিজোরামের অন্যান্য জনজাতির মতো এরাও খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। এরা ব্রিটিশ শাসনকালে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা সর্বপ্রথম খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। এই জনজাতি কয়রকটি গোত্রে বিভক্ত যথা বামখাই, বিয়াংতুং, বুকপি, দোলবাক, দৌসেল, গেঞ্জো, হাঙ্গাল, হাতলাং ইত্যাদি।
পাইতে জনজাতি মূলত গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করে একজন প্রধানের অধীনে। গ্রামের প্রধানকে ‘হাউসাপা’ বলা হয়, যিনি গ্রামের অন্তর্গত সমস্ত জমির মালিকানা লাভ করেন। যখনই এরা কোনো পশু শিকার করে অথবা গবাদি পশু কেনে, তখন তার একটি অংশ প্রধানকে দিয়ে দিতে হয়। গ্রামের শাসনকাজে প্রধানকে সাহায্য করার জন্য বয়স্ক ব্যাক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি গ্রাম সংসদ থাকে যারা গ্রামীণ পারিবারিক ও জমি সংক্রান্ত বিবাদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। পাইতে সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, এখানে পিতার মৃত্যুর পর পুত্র সম্পত্তির অধিকার লাভ করে। পাইতে সমাজে সম্পত্তির উপর মহিলাদের কোনো উত্তরাধিকার স্বীকার করা হয় না। দুঃস্থ ব্যাক্তি ও বিধবাদের সাহায্য করা পাইতে জনজাতির মধ্যে প্রধান কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত হয়। এদের প্রাচীন নিজস্ব ধর্মে কয়েকটি স্পিরিট অর্থাৎ আত্মার উপাসনা করা হতো। এদের ফসল বোনার উৎসব হলো খোদোউ।
পাইতে সমাজে অন্যান্য জনজাতির মতোই প্রেমবিবাহ, সম্বন্ধবিবাহ ও বলপূর্বক বিবাহ প্রচলিত। তবে পাত্রের বয়স ১৬ পূর্ণ হলে ছেলের বাড়ির তরফ থেকে পাত্রী খোঁজার রীতি রয়েছে। পুরুষদের বহুবিবাহ পাইতে সমাজে স্বীকৃত নয়, বিধবাবিবাহের প্রথাকেও অনুৎসাহিত করা হয়। বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদও অনুমোদিত নয়। মৃত্যুর পর মৃতদেহকে সমাধি দেওয়া হয় এবং ৮দিন ধরে শোকপালনের পর নবম দিনে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করা হয়। মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে চাল, শুকরছানা ও মুরগি ইত্যাদি উৎসর্গ করা হয়ে থাকে।
তবে বর্তমানে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে এবং খ্রিষ্টান ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে পাইতে সমাজের প্রাচীন রীতিনীতিগুলির অভ্যাস ক্রমশ কমছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলয়ের পাঠক্রমে ভাষাটির অন্তর্ভুক্তি এই ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলির সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির ক্রমশ অবনমন ঘটছে। এদের পরিযায়ী প্রকৃতির জন্য এরা নতুন জায়গার সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে দ্রুত অভিযোজিত হতে সক্ষম; ফলে এদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি সেভাবে সংরক্ষিত হয় না। এছাড়া নতুন প্রজন্মের মধ্যে সুপ্রাচীন প্রথাগুলির অনুশীলনের অনিহা থাকায় পাইতে সমাজ সংস্কৃতির ক্রমাবনমন ঘটছে।
Census of India, 2011
Ousangvualnam, Liang. 2010 Community Organization of Paite Tribe Wordpress
Chemjong, I.S. “History and Culture of the Kirat”.
Singh, C.Y. 1995 The Linguistic Situation in Manipur, Linguistics of the Tibeto-Burman Area 18
Singh, N.S. 2006 A Grammar of Paite, Mittal Publishers