বীরভূম জেলা
বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত উত্তরতম জেলা হলো বীরভূম জেলা। এই জেলার উত্তর ও পশ্চিমাংশে ঝাড়খণ্ড রাজ্য এবং পূর্বে মুর্শিদাবাদ জেলা অবস্থিত। অজয় নদ বীরভূম জেলাকে বর্ধমান জেলা থেকে পৃথক করেছে। বীরভূম জেলার পশ্চিমাংশ ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বীরভূম জেলার মোট আয়তন ৪৫৪৫ বর্গকিমি এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই জেলার মোট জনসংখ্যা ৩৫০২৪০৪ জন এবং জনঘনত্ব ৭৭০ জন/ বর্গকিমি। বীরভূম প্রধানত কৃষিপ্রধান জেলা; এই জেলার ৭৫ শতাংশ অধিবাসী কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া রেশম ও তাঁতশিল্প, ধাতু ও মাটির বাসনপত্র তৈরীর প্রচলন আছে।
বীরভূম জেলার প্রধান সরকারি ভাষা বাংলা। তবে বীরভূম জনজাতি অধ্যুষিত জেলা হওয়ার ফলে সাঁওতালি, মুণ্ডারি, মাহালি, কোড়া ইত্যাদি জনজাতির ভাষাগুলিও বীরভূম জেলায় প্রচলিত। এই জেলার জনজাতি জনসংখ্যার সিংহভাগ সাঁওতাল। আঞ্চলিকভাবে এরা ‘মাঝি’ নামে পরিচিত এবং তফশিলি জাতির মর্যাদাভুক্ত। সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাবংশের উত্তর মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত। এই ভাষা পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সরকারি ভাষা; এই ভাষার নিজস্ব অলচিকি লিপির বিকাশের কারণে মৌখিক ছাড়াও লিখিত সাহিত্যের বিকাশ এবং সাঁওতালি মাধমে লেখাপড়া করার সুবিধা রয়েছে।
এছাড়া বীরভূম জেলায় মাহালি জনজাতিরও বসবাস আছে। রাসেল ও হীরালাল ( ১৯৭৫, ১৪৬-১৪৮) এর মতে মাহালি ও সাঁওতাল উভয়ে একই উপজাতির অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু মাহালিরা তুলনামূলকভাবে সাঁওতালদের থেকে সামাজিকভাবে নিম্নতর অবস্থানে রয়েছে, কারণ মাহালিরা হিন্দুদের অধীনে ভূমিদাস হিসেবে কাজ করে থাকে। বর্তমানে মাহালি জনজাতির মূল জীবিকা বাঁশের কাজ। মাহালি ভাষা অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠির অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাপরিবারের মুণ্ডারি শাখার অন্তর্গত। মাহালি ভাষা শাব্দিক ও ধ্বনিগত দিক থেকে মুণ্ডারি শাখার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও শব্দভাণ্ডারের প্রতি ঋনী। সামাজিক সম্পর্কসূচক শব্দগুলির সঙ্গে কিছু উপসর্গ ও অনুসর্গ জুড়ে তারা সামাজিক পদমার্যাদা, বয়স ইত্যাদি বিষয়গুলির সামঞ্জস্য রক্ষা করে। লিঙ্গগত বৈচিত্রের সূচক হিসেবে মাহালি ভাষায় ‘কোড়া’, ‘কুড়ি’, ‘গিদরা’ ইত্যাদি শব্দ প্রচলিত। প্রজন্মগত বৈসাদৃশ্যের ক্ষেত্রে ‘গারোম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। মাহালি ভাষার সামাজিক সম্পর্কবাচক শব্দগুলি বক্তার লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয় না।
বীরভূম জেলায় কোড়া জনজাতির মানুষও বসবাস করে। কোড়া জনজাতি আদি অস্ট্রাল-মুণ্ডা উপজাতির একটি পৃথক শাখা। ‘মাটি কাটা’ কে পেশা হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে কোড়াদের সাথে মুন্ডাদের বিভাজন ঘটে; যে কারণে কোড়াদের সামাজিক ও ভাষিক বৈশিষ্ট্যে মুন্ডা উপজাতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ভাষা বিশেষজ্ঞ ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের মতে, অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর মুণ্ডারি শাখার অন্তর্গত ১১ টি ভাষার একটি হলো কোড়া। কোড়া ভাষার সাথে অন্যান্য অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের ভাষা- সাঁওওতালি, মুণ্ডারি, কোল ইত্যাদির আভিধানিক ও শব্দকোষ- সম্বন্ধীয় সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। উক্ত মাপকাঠির প্রেক্ষিতে কোড়া ভাষার সঙ্গে উপরোক্ত তিনটি ভাষার যথাক্রমে ৪৯-৫৫ শতাংশ, ৬১-৬৭ শতাংশ এবং ৫৭-৬০ শতাংশ সাদৃশ্য বর্তমান।
বীরভূম জেলায় বিভিন্ন জনজাতির পাশাপাশি অবস্থানের কারণে একটি সম্বৃদ্ধ লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। জনজাতি সমূহের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীনিকেতন ক্যাম্পাসে কৃষি, পশুপালন এবং কুটির শিল্পের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
