খোট্টা ভাষা

খোট্টা ভাষা মূলত পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার কালিয়াচক ১ ও ২, হরিশচন্দ্রপুর, রতুয়া ও মানিকচক ব্লক এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ফারক্কা, শামসেরগঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ ও সুতি ১ ও ২ ব্লকের কিছু মানুষের মুখের ভাষা। এছাড়া বীরভূম, দুই মেদিনীপুর ও হুগলি জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে এই জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ভাষা কোরঠার সঙ্গে খোট্টার বিশেষ পার্থক্য বর্তমান- কোরঠার লিখিত রূপ ও সাহিত্য বর্তমান হলেও খোট্টা ভাষার কোনো লিখিত রূপের অস্তিত্ব নেই। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০ লাখ মানুষ খোট্টা ভাষা ব্যবহার করেন। এই ভাষার মানুষজন মূলত মুসলিম ধর্মাবলম্বী।

খোট্টা ভাষা মূলত হিন্দি, উর্দু ও বাংলা ভাষার একটি মিশ্রিত রূপ; যা সময়ের সঙ্গে একটি নিজস্ব রূপ ধারণ করেছে। রিসলে উত্তর মানভূম অঞ্চলে প্রচলিত ভাঙা হিন্দিকেই খোট্টা মুসলিম ভাষা নামে অভিহিত করেছেন। বর্তমানে সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেই ভাষাটি ব্যবহৃত হয়; এদের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মূলত বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে স্কুলছুটের হার অত্যধিক। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ ছেলেমেয়ে শিক্ষাক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে।

খোট্টা ভাষায় ব্যবহৃত বিশেষণ, ক্রিয়া এবং সম্পর্কসূচক শব্দ- সব ক্ষেত্রেই বাংলা ও হিন্দির প্রভাব রয়েছে। বাংলা বিশেষণ ‘ভালো’, ‘লম্বা’, ‘উচু’, ‘নিচু’, ‘বড়ো’, ‘ছোট’ ইত্যাদি খোট্টা ভাষায় আংশিক রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে যথাক্রমে ‘আচ্ছা’, ‘লাম্বা’, উচ্চা’, ‘নিচ্চা’, ‘বড়া’, ‘ছোটা’ ইত্যাদিতে পরিণত হয়। হিন্দির ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টি এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। সম্পর্কসূচক শব্দের ক্ষেত্রে ‘বাবা’, ‘মা’, ‘কাকা’, ‘পিসি’ ইত্যাদি বোঝাতে যথাক্রমে ‘আব্বা’, ‘আম্মা’, ‘চাচা’ ও ‘ফুফু’ শব্দ ব্যবহৃত হয় যেগুলি মূলত হিন্দি ও উর্দু থেকে অবিকৃত অবস্থায় খোট্টা ভাষার শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছে। ‘যাচ্ছি’, ‘খাচ্ছি’, ‘দিয়েছে’ ইত্যাদি ক্রিয়াপদের রূপ যথাক্রমে ‘যানহেন’, ‘খানহেন’ ও ‘দিসে’ যেগুলি বাংলা ও হিন্দির রূপ থেকে সামান্য পৃথক।

খোট্টা ভাষায় লিঙ্গ এর রূপ বাংলার থেকে আলাদা। বাংলায় লিঙ্গভেদে ক্রিয়ার রূপ পরিবর্তিত হয় না, কিন্তু খোট্টা ভাষা হিন্দির অনুসরণে এই বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ করে। ‘সে এসেছিল’ এই বাক্যটিতে লিঙ্গভেদে ক্রিয়ারূপ অপরিবর্তিত থাকলেও খোট্টা ভাষায় লিঙ্গভেদে ক্রিয়ারূপের পরিবর্তন ঘটে। পুংলিঙ্গের ক্ষেত্রে ‘উও আয়াথা’ এবং স্ত্রীলিঙ্গের ক্ষেত্রে ‘উও আয়িথি’ ব্যবহৃত হয়। খোট্টা ভাষা কেবলমাত্র মানুষ সম্বন্ধীয় পদের জন্য এই পার্থক্যটি প্রদর্শন করলেও হিন্দি ও উর্দুর মতো প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত বিভেদ প্রদর্শন করে না। খোট্টা ভাষার উচ্চারণ রীতিও হিন্দি উচ্চারণ রীতিকে অনুসরণ করে। ‘পরীক্ষা’, ‘ঘর’, ‘কবর’ ইত্যাদি শব্দ খোট্টা ভাষায় ‘পারীক্ষা’, ‘ঘার’, ‘কাব্বার’ ইত্যাদি রূপে উচ্চারিত হয়। খোট্টা ভাষার বাকরীতি ও উচ্চারণ পদ্ধতি স্থানভেদে পরিবর্তিত হয়। যেমন- দক্ষিণ মালদহ অঞ্চলে ব্যবহৃত খোট্টার রূপ মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে প্রচলিত খোট্টার থেকে পৃথক। লিখিত সাহিত্যের অভাব থাকলেও ‘গীত’ নামে খোট্টা সমাজের নিজস্ব একপ্রকার গানের অস্তিত্ব রয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী :

Census of India, 2011.

Chowdhury, Patit Paban (2013). “Maldah jelar Khottrabhasha: bhasa tattwik parjabekkhan” University of North Bengal”.

“Khotta Language: Linguistic and Grammatical Identification”. academia.edu