খাড়িয়া জনজাতির উহয়। পবিভাগগুলির মধ্যে পাহাড়ি খাড়িয়া উপবিভাগটি নিজেদের ‘খাড়িয়া-শবর’ নামে অভিহিত করে। এদের মধ্যে অনেকগুলি গোত্রের অস্তিত্ব রয়েছে, যেমন- গলগো, ভুঁইয়া, সান্দি, গিদি, দেহুরি, নাগো, তোলোং ইত্যাদি। এদের মধ্যে গলগো গোত্রটির অন্তর্ভুক্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরা মূলত ওড়িশা উপকূলের আদি বাসিন্দা হলেও পরবর্তীকালে বহিঃশত্রুর আক্রমণের ফলে এরা ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে সরে এসে জঙ্গলকেন্দ্রিক নোম্যাডিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনকালে এরা স্থানীয় জমিদারের অধীনে লাঠিয়াল হিসেবে এবং সেনাবাহিনিতে সৈনিক হিসেবে কাজ করলেও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তবে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অনুর্বর মৃত্তিকা ও চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর কারণে চাষের কাজে অসুবিধে হয়। মূলত জঙ্গল থেকে কাঠ, মধু ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। খাড়িয়াদের অর্থনীতি কুটিরশিল্পের উপরেও নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতারর কারণে এবং এই জনজাতির বেশিরভাগ মানুষ ভূমিহীন হওয়ার ফলে নিজেদের বাড়িতে কুটির শিল্পভিত্তিক জিনিসপত্রের উৎপাদন এদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান উপায়।
পাহাড়ি খাড়িয়াদের মধ্যে এদের নিজস্ব সংস্কৃতির বেশ কিছু নিদর্শন দেখা গেলেও অন্য দুই গোষ্ঠীর খাড়িয়াদের মধ্যে আধুনিকতার যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছে। পাহাড়ি খাড়িয়াদের পরিহিত বস্ত্রের মধ্যেও নিজস্বতার ছাপ রয়েছে। এদের প্রধান পরিধেয় বস্ত্র হলো ধুতি, যা ‘ভাগওয়ান’ নামে পরিচিত। মহিলাদের পোশাক শাড়ি হলেও পৃথক বক্ষবন্ধনীর অস্তিত্ব নেই। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই ব্রাশ, নিকেল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গয়নার জনপ্রিয়তা রয়েছে। খাড়িয়া জনজাতির মধ্যে নিজস্ব কিছু নৃত্যশৈলীর অস্তিত্ব রয়েছে, যেমন- ‘হারিও’, ‘কিনভার’, ‘কুধিং’, ‘যাধুরা’ ইত্যাদি।
খাড়িয়া সমাজ পিতৃতান্ত্রিক; এদের মধ্যে যৌথ পরিবার প্রথা বহুল প্রচলিত নয়। এদের সমাজে মনোগ্যামি অর্থাৎ একগামীতাই স্বীকৃত। খাড়িয়া সমাজে বিবাহের পূর্বে একটি ‘এনগেজমেণ্ট’ এর অনুষ্ঠান হয়, যা ‘লাম’ নামে পরিচিত। বিবাহ মূলত কন্যার বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। দুধ খাড়িয়াদের মধ্যে অন্য জনজাতির (মূলত ওঁরাও, মুন্ডা ও কিষাণ) ছেলে বা মেয়েকে বিবাহ অনুমোদিত নয়।
খাড়িয়া জনজাতি অ্যানিমিজমে বিশ্বাসী হলেও পরবর্তীকালে এদের মধ্যে লৌকিক হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এদের প্রধান দেবতা হলেন ‘গেরিং’ অথবা ‘বেরো’, এবং ‘বুঢ়হা-বুড়হি’। এরা পুর্বপুরুষদের মৃত আত্মার উপাসনাও করে থাকে। মূলত শিকার এবং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করার সময় খাড়িয়া জনজাতি দেবতা ও পূর্বপুরুষের উপাসনা করে থাকে। এই আত্মাগুলি প্রধানত কোনো পাহাড়ের নামে পরিচিত হয়। ‘বেরো’ অর্থাৎ সূর্যদেবতাকে এরা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পূজা করে। ধর্মীয় উৎসবগুলি ছাড়াও অন্যান্য উৎসবের মধ্যে সারহুল, দিমতাং পূজা, আষাধি পূজা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিবছর বসন্তকালে যখন শাল গাছে নতুন পাতা জন্মায় তখন সারহুল উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবে খাড়িয়া জনজাতি গ্রামদেবতার উপাসনা করে। শাল গাছের ফুল সহযোগে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামের পুরোহিত ‘পাহান’ নামে পরিচিত, যিনি শাল গাছের ফুল সমস্ত গ্রামবাসীর মধ্যে বিতরণ করেন। খাড়িয়া ভাষায় দিমতাং পূজা ‘দিমতাং সুং’ নামে পরিচিত। বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত হয় বলে এই পূজা ‘বৈশাখী পূজা’ নামেও পরিচিত। এই উৎসবে মূলত কৃষিকাজে সহায়ক গবাদিপশুর উপাসনা করা হয়। আষাধি পূজা আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এটি ফল খাওয়ার উৎসব হিসেবেও পরিচিত। পূজার পর খাড়িয়া জনজাতির কালো জাম খাওয়া অনুমোদিত হয়। এছাড়া আশ্বিন মাসে ফসল বোনার পর কিষাণ তথা কৃষকদের পালিত ‘কাদালেতা’ উৎসবও উল্লেখযোগ্য।
তবে বর্তমানে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবে এদের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এদের মধ্যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার বিকাশও প্রাচীন প্রথাগুলির বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া সাঁওতালি, মুন্ডারি, সাদরি প্রভৃতি সরকারি ও আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবে খাড়িয়া ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি বিমিশ্রণের শিকার হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে খাড়িয়া ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষারও সুযোগ নেই। ফলে খাড়িয়া জনজাতির শিশুদের ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে তাদের নিজস্ব ভাষাগত ঐতিহ্য সম্পর্কে কোনো সচেতনতা গড়ে ওঠেনি; ফলে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলিও ধীরে ধীরে অবলুপ্তির সম্মুখীন হচ্ছে। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় খাড়িয়া ভাষা ‘ভালনারেবল’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে।
Anderson, G.D.S. 2008; The Munda Languages
Banerjee, G.C. Introduction to Kharia Language; Bengal Secretariat Press
Bagchi, T, (Rev.) Grammar of Kharia: A South Munda Language; John Peterson. Himalayan Linguistics, 2011
Census of India- 2011
Dash, B. 2020; Socio-Cultural Transformation of Kharia Tribes. International Journal of Research and Review