পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

আসুরি সংস্কৃতি

এই জনজাতির প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে এদের প্রধান জীবিকা ছিল লোহার জিনিসপত্র তৈরি। কিন্তু ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে, এই জনজাতির মানুষদের প্রায় ৯১ শতাংশ কৃষিকাজকেই মূল জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছে। লোহার জিনিসপত্র তৈরির পেশাই অসুর জনজাতিকে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে বসবাসকারী অন্যান্য জনজাতির থেকে পৃথক করেছে। পুরাণে উল্লিখিত ‘অসুর’ সম্প্রদায়কে এখনকার অসুর জনজাতি তাদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করে। ভারতীয়-আর্য সংস্কৃতির তুলনায় দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে অসুর জনজাতির অধিক সাদৃশ্যই এই বিষয়টির সাক্ষ্য বহন করে। অসুর জনজাতির মধ্যে ১২টি গোত্রের অস্তিত্ব রয়েছে। এই গোত্রগুলির নামকরণ পশু, পাখি এবং শস্যদানার নাম অনুসারে দেওয়া হয়েছে। এদের সমাজের নিজস্ব সংসদই এদের জাতিগত বিবাদ এবং অন্যান্য বিষয়ের সমাধান করে থাকে। রাজপুত, ওঁরাও, খেরওয়াড়, ঠাকুর, ঘাসী ইত্যাদি জনজাতির কাছ থেকে অসুর জনজাতি খাদ্যকণা গ্রহণ করে। মৃতদেহের সমাধি দেওয়ার স্থান ছাড়া অন্য যেকোনো স্থান অসুর জনজাতি অন্যান্য জনজাতির সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। জঙ্গলের মধ্যে একটি পরিষ্কার করা জায়গায় (যা ‘পাট’ নামে পরিচিত) অসুর জনজাতি বসবাস করে। এদের বাড়িগুলি বাঁশ ও খড় দিয়ে তৈরি হয়; এবং ঘরের দেওয়াল কাদা দিয়ে নির্মীত হয়। বর্তমান কালে অসুর জনজাতি তিনটি ভাগে বিভক্ত-বীর (কোল) অসুর, বির্জিয়া অসুর এবং আগাড়িয়া অসুর। এই বির্জিয়ারা বর্তমানে একটি পৃথক তফশিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃত। অসুর জনজাতির ধর্মীয় বিশ্বাসে অ্যানিমিজম, অ্যানিমেটিজম, ন্যাচারালিজম এবং অ্যানসেস্ট্রাল ওরশিপ অর্থাৎ পূর্বপুরুষের উপাসনা-এর চারটি প্রথাই রয়েছে। এদের প্রধান দেবতা হলেন ‘সিং-বোঙ্গা’। এছাড়া অন্যান্য দেবদেবীর মধ্যে ‘ধরতি মাতা’, দুয়ারি’, ‘তুরী হুসীদ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এদের পালিত উৎসবের মধ্যে ‘সারহুল’, ‘ধানবুনি’, কাদেলতা’, ‘দশহরা’, ‘করম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দুর্গাপূজার সঙ্গে যুক্ত মহিষাসুরকে অসুর জনজাতি নিজেদের পূর্বপুরূষ হিসেবে মনে করে ‘হুদুড় দুর্গা’ হিসেবে তার উপাসনা করে থ্যাকে। অসুর সমাজ মূলর মনোগ্যামাস অর্থাৎ একগামী হলেও স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকক্ষেত্রে বহুগামীতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অসুর সমাজে বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রথাও স্বীকৃত। বিবাহের ক্ষেত্রে অসুর সমাজে ‘ট্রাইব-এণ্ডোগ্যামি’র প্রথা প্রচলিত রয়েছে। অসুর জনজাতি লোকালয় থেকে দূরে জঙ্গলের মধ্যে বসবাসের কারণে আধুনিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে এদের মধ্যে শিক্ষিত জনসংখ্যা শতাংশের হিসেবে খুব নগন্য। আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুযোগ না পাওয়ায় এদের গড় আয়ু অন্যান্য জনজাতির তুলনায় কম। এই জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বক্সাইটের খনি আবিষ্কারের ফলে এই জনজাতির কৃষিভিত্তিক জীবন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এর ফলে অসুর জনজাতির জীবনে পরিযান অর্থাৎ মাইগ্রেশন একটি চিরস্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দারিদ্র্যের কারণে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের পাচার করে দেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। এই সমস্ত অসুবিধার কারণে অসুর জনজাতির মধ্যে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণের কোনো বিশেষ উদ্যোগ বা সচেতনতা চোখে পড়ে না। বর্তমানে সুষমা অসুর নামে এক ভদ্রমহিলা অসুর জনজাতির নিজস্ব গান, নাচ, চিত্রকলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে অসুর জনজাতির নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ শিশু ও যুবকরা আসুরি ভাষা শিখতে আগ্রহী নয়। ফলে ভাষাটির এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে সঞ্চারণের পথে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় আসুরি ভাষা ‘ডেফিনিটলি এণ্ডেঞ্জারড’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Asuri; www.ethnologue.com

Baskaran, S.G. 2015; Consonant Sequence and Syllable Formation in Asuri; Language in India

Baskaran, S.G. 2015; Phonemes of Asuri, Language in India; www.languageinindia.com

Census of India-2011